১৫ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত ৬৩৪ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)। অথচ সারা দেশে কর্মরত সাড়ে ১৪ হাজার নারী ও পুরুষ সিএইচসিপির জন্য বাইক ও স্কুটি কেনার ‘বিলাসী’ প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব বাইক-স্কুটি কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াইশ কোটি টাকা।
প্রস্তাবটি এখন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতে বাইক বা স্কুটি কেনাটা জরুরি নয়, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ, নিয়মিত বেতন ও ইনক্রিমেন্ট। এসব রেখে যানবাহন কেনা অর্থের অপচয়।
সারা দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো মাতৃত্বকালীন, গর্ভকালীন ও প্রসূতি সেবা, শিশুরোগের সমন্বিত চিকিৎসা, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান, নবদম্পতি নিবন্ধন, জন্ম-মৃত্যু ও প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ নিবন্ধন, পুষ্টি শিক্ষা ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করে। বছরে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ এ ক্লিনিকের সেবা গ্রহণ করেন।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। দেশব্যাপী প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৪ হাজার ৫০০ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) কর্মরত আছেন। সেবার মান আরও গতিশীল করার জন্য যাতায়াতে সুবিধার্থে কর্মরত পুরুষ সিএইচসিপিদের একটি করে বাইক এবং নারী সিএইচসিপিদের একটি করে স্কুটি প্রদান করা প্রয়োজন।
কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামানের সই করা ওই আবেদনে বলা হয়, ১৪ হাজার ৫০০টি মোটরসাইকেল এবং স্কুটি কেনায় ব্যয় হবে ২৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। প্রতিটি বাইক এবং স্কুটির কেনা হবে গড়ে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায়। এজন্য মন্ত্রণালয়ের অনুদান খাত থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের অনুকূলে বরাদ্দ প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়।
কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, দেশে রোগীর চাপ কমাতে হলে রোগ প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। সাধারণ মানুষের কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতি আস্থা ও আগ্রহ বেড়েছে। রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতামূলক কাজ আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এজন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত পুরুষ ও নারী সিএইচসিপিদের কাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং যাতায়াতের সুবিধার্থে বাইক ও স্কুটি কেনার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সাড়ে ১৪ হাজার জনবল এসব যানবাহন ব্যবহার করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পারবে।
১৫ মাস ধরে ৬৩৪ সিএইচসিপি বেতন পাচ্ছেন না: ১৫ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত ৬৩৪ জন সিএইচসিপি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ১৩ হাজার ৯২৩টি পদ অনুমোদন এবং পদ সৃজন করা হয়েছে। এতে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে। কিন্তু ২০২৩ সালে নিয়োগ পাওয়া ৬৩৪ জনকে বেতন-ভাতাদি দেওয়া হচ্ছে না। বকেয়া বেতনের দাবিতে সম্প্রতি সিএইচসিপিরা ক্লিনিক ট্রাস্ট কার্যালয় অবরুদ্ধও করেছিলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, সিএইচসিপিরা কমিউনিটি ক্লিনিকের আশপাশের মানুষ। তাদের যাতায়াতে বাইক বা স্কুটি কেনার প্রস্তাব খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিটি ক্লিনিকের সব জনবলের চাকরি স্থায়ীকরণ, নিয়মিত বেতন ও ইনক্রিমেন্ট। এসব রেখে যানবাহন কেনা অর্থের অপচয় মনে করি।
তিনি বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের অনেক জায়গায় ভবন পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। সেগুলো পুনর্নির্মাণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় কাজের জন্য স্মার্ট ডিভাইস, যেমন ল্যাপটপ অথবা ট্যাব বেশি জরুরি। বাইক কিংবা স্কুটি কেনা জরুরি নয়।
৫ হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পুনর্নির্মিত হবে: কম বরাদ্দ এবং নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে বিদ্যমান সাড়ে ১৪ হাজারের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ক্লিনিকের অবকাঠামোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ৫ হাজার ৮০টি ক্লিনিককে উচ্চ ও মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা এরই মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বর্তমানে ১৪ হাজার ৪৬৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে ১৪ হাজার ৩৬৩টি। সচল ক্লিনিকের মধ্যে ৫ হাজার ৮০টিকে উচ্চ ও মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে ৫৯৩টি উচ্চ ও ২৭২টি মধ্যম, রংপুরে ৪১৪টি উচ্চ ও ৩০৯টি মধ্যম, খুলনায় ৩০৩টি উচ্চ ও ২৯৭টি মধ্যম, সিলেটে ১৬২টি উচ্চ ও ১১৪টি মধ্যম, ময়মনসিংহে ৩৬১টি উচ্চ ও ১১৪টি মধ্যম, রাজশাহীতে ৪১৩টি উচ্চ ও ২৫৫টি মধ্যম, বরিশালে ৩১৭টি উচ্চ ও ১৭৪টি মধ্যম এবং চট্টগ্রামে ৫৭৩টি উচ্চ ও ২৯৮টি মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ ক্লিনিক রয়েছে। প্রতিটি ক্লিনিকে একজন সিএইচসিপির পাশাপাশি স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারী সপ্তাহে দুদিন সেবা দিয়ে থাকেন। প্রতিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ১৩ থেকে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিউনিটি গ্রুপের মাধ্যমে। বর্তমানে দেশে সিএইচসিপির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯২৩ জন।
নাম বদলে যাচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিকের: কমিউনিটি ক্লিনিকের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নাম গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের পদবি ও কাজের পরিধি পরিবর্তনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। ক্লিনিকগুলোকে কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম আরও কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া সব সিএইচসিপি ও প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত জনবলের চাকরি কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টে ন্যস্ত করে ২০১৮ সালের ট্রাস্ট আইন দ্রুত বাস্তবায়ন, প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন, কর্মরত জনবলের বেতন-ভাতাদি আইবিএএসের মাধ্যমে প্রদান, ট্রাস্টের কর্মচারীদের জন্য খসড়া চাকরি প্রবিধানমালা চূড়ান্তকরণ এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সেবাদানকারীদের মান বজায় রাখারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করা; সাপ্লাই চেইনের উন্নতি করা; প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় অতি জরুরি বিপি মেশিন, ওয়েট মেশিন, গ্লুকোমিটার, নেবুলাইজার, লিফলেটসহ অন্য জিনিসপত্র সরবরাহ করা; গর্ভবতী মায়েদের একলামশিয়া রোধে রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার সহজ ডিপস্টিক টেস্টের স্ট্রিপ সরবরাহ এবং রেফারেল সিস্টেম শক্তিশালী করার কথা ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা: কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের নিজস্ব ভবন ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ডিজিটাল রেফারেল সিস্টেম তৈরি করে সেবাগ্রহীতার সেবা পাওয়া ট্র্যাকিং ও নিশ্চিত করা হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের নিজস্ব সার্ভার স্থাপন, কমিউনিটি ক্লিনিকে এখন কর্মরত জনবলের ৫৪ শতাংশ নারী থেকে পর্যায়ক্রমে ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি বৃদ্ধি করা হবে। কর্মরত নারী সিএইচসিপিদের ধাত্রীবিদ্যা প্রশিক্ষণ দিয়ে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় জোর দেওয়া হবে। এ ছাড়া শূন্যপদে নিয়োগ ও জনবল বৃদ্ধি, সিএইচসিপিদের মৌলিক প্রশিক্ষণ, টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ ও রিফ্রেশার প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধিতে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন; ক্লিনিকের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার জনগণের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা (প্রিভেন্টিভ ও হেলথ প্রোমোটিভ) প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পেইন চালানো; রিপোর্টিংয়ের জন্য নষ্ট ল্যাপটপগুলো ট্যাবলেট পিসি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা; রিপোর্টিংয়ের মান নিশ্চিত করা; কমিউনিটি গ্রুপ গঠনের নীতিমালা নবায়ন করে তার কার্যক্রম গতিশীল করার কথা বলা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, পাইলট প্রকল্প হিসেবে পিপিপি মডেলে কিংবা স্ট্র্যাটেজিক পারচেজিং মেথডে আরবান কমিউনিটি ক্লিনিক চালুকরণ ও ধাপে ধাপে সম্প্রসারণ। বিশেষ অঞ্চল তথা হাওর, চর, উপকূলীয় ও পাহাড়ি অঞ্চলে চাহিদার ভিত্তিতে প্রতি দেড় থেকে দুই হাজার জনের জন্য একটি ক্লিনিক স্থাপন করা হবে। ক্লিনিকগুলোতে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা; বছরে কমপক্ষে একবার গ্রামীণ বয়স্ক জনগণের বেসিক হেলথ চেকআপ নিশ্চিত করা; এনজিও ও বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাদানকারী সংস্থাকে সহযোগী হিসেবে কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান; স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনায় ও জন অংশীদারত্বের মাধ্যমে ক্লিনিকগুলোতে আসবাবপত্র প্রদান; সীমানা নির্ধারণ ও বেড়া দেওয়া, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিশ্চিত করা; সিসিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা উচ্চতর স্থাপনার সঙ্গে সংযুক্ত করে টেলিমেডিসিন সেবা চালুকরণ এবং স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় দেশীয় অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন