দেশের আমদানি নীতি অনুযায়ী যৌন উত্তেজক ওষুধ ভায়াগ্রা তৈরির কাঁচামাল সিলডেনাফিল সাইট্রেট ব্লক লিস্টেড পণ্য (ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া আমদানি নিষিদ্ধ), যা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে একমাত্র ফার্মাসিউটিউক্যাল কোম্পানি আমদানি করতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যিক আমদানিকারক রাজধানী ঢাকার উজালা পেইন্ট ট্রেডিং কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণায় কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়া দেশের ইতিহাসে অন্যতম রেকর্ড ৫ হাজার ৮০৫ কেজি সিলডেনাফিল সাইট্রেট নিয়ে এসেছে। চায়না ক্লে (খেলনা তৈরির কাঁচামাল) ঘোষণায় শুধু ভায়াগ্রার কাঁচামালই নয়, আরও ৩৮ ধরনের ওষুধের কাঁচামাল নিয়ে এসেছে আমদানিকারক এই প্রতিষ্ঠান। ঘটনাটি ঘটেছে দেশের অন্যতম স্থলবন্দর দিনাজপুরের হাকিমপুরের হিলিতে।
রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা সিলডেনাফিল সাইট্রেটের ওই চালানটি আটকে দেওয়ার পর টনক নড়ে কাস্টমসের। তবে নাটকীয়তার এখানেই শেষ নয়, সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক এবং চালানটি ছাড়ানোর দায়িত্বে থাকা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
কালবেলার অনুসন্ধানে জানা যায়, হিলি শুল্ক স্টেশনে গত ৭ আগস্ট চায়না ক্লে পাউডার ঘোষণায় বিল অব এন্ট্রি (মূল্য, প্রকৃতি, পরিমাণের মতো পণ্যের বিস্তারিত সব তথ্য উল্লেখ করে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ) দাখিল করে উজালা পেইন্ট ট্রেডিং কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি ৩০ হাজার ৬৬৮ কেজি বা সাড়ে ৩০ টন ক্লে পাউডারের ঘোষণা দেয়। আর সে অনুযায়ী কাস্টমস অ্যাসেসমেন্টও (পণ্যের ওপর প্রযোজ্য শুল্ক এবং অন্যান্য কর নির্ধারণ ও আদায়ে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া)Ñশুরু করে। সবকিছু চলছিল পূর্বপরিকল্পিত ছক অনুযায়ীই। তবে বিপত্তি বাধে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে চালানটির বিষয়ে আপত্তি আসার পর। গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর এই পণ্যের চালানটি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে। আর এতে করে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ এক জালিয়াতির চিত্র। সাড়ে ৩০
টন পণ্য পরীক্ষার পর দেখা যায়, এই চালানে চায়না ক্লে প্রকৃতপক্ষে মাত্র সাড়ে ১৪ টন। বাদবাকি সবই ওষুধের কাঁচামাল। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো চালানটিতে মেলে ছয় টনের কাছাকাছি যৌন উত্তেজক ওষুধ ভায়াগ্রা তৈরির কাঁচামাল সিলডেনাফিল সাইট্রেট। দেশের বিদ্যমান আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরনের ওষুধের কাঁচামাল শুধু ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আমদানির সুযোগ রয়েছে। সাধারণত কোনো বাণিজ্যিক আমদানিকারকের ওষুধ তৈরির এমন কাঁচামাল আমদানির কোনো সুযোগ নেই। কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, রংপুরের আওতাধীন হিলি স্টেশন দিয়ে আমদানি হওয়া এই ব্লক লিস্টেড পণ্যের চালান আটকে যাওয়ার কথা ছিল কাস্টমস কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে। অথচ তা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় চিহ্নিতের পর এখন প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে কার্যত গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটের বিরুদ্ধে।
ভায়াগ্রার কাঁচামাল আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, রংপুরের কমিশনার অরুণ কুমার বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর হওয়ায় ব্যবস্থা নিতে একটু সময় লাগছে। তবে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফের এ আইন লক করা হয়েছে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে মামলা করা হবে।’
ব্যবস্থা নিতে বিলম্বের কারণ হিসেবে এই কাস্টমস কমিশনার বলেন, মামলা করার আগে আমদানিকারককে দুবার শোকজ (কারণ দর্শানোর নোটিশ) দিতে হয়। এ কারণে সময়ক্ষেপণ হয় বলে দাবি এই কাস্টমস কর্মকর্তার। এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস পলিসির সদস্য থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে বলে জানান এই কমিশনার। মামলার পর পণ্যের চালানটির জন্য দ্বিগুণ জরিমানা ও বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে বলেও জানান অরুণ কুমার বিশ্বাস।
কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী, উজালা ট্রেডিং কোম্পানি আলোচিত এই পণ্য চালানে চায়না ক্লে ছাড়াও আরও ৩৭ ধরনের ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করেছে। ৩০ হাজার ৬৬৮ কেজির এই পণ্য চালানে চায়না ক্লে ১৪ হাজার ৪৫৩ কেজি। আর ভায়াগ্রার কাঁচামাল ৫ হাজার ৮০৫ কেজি। এ ছাড়া ওমিপ্রাজল রয়েছে ৪ হাজার ৩০৭ কেজি বা চার টনেরও বেশি। সিত্রাল ক্যাফেইন থেকে শুরু করে আরও ৩৫ ধরনের ওষুধের কাঁচামাল রয়েছে এই পণ্য চালানে। ওষুধের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি নীতি আদেশে বলা হয়েছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে আগেই অনুমোদন নিতে হবে। সেক্ষেত্রে যে ধরনের ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করা হবে, সেসব ওষুধের পরিমাণ, ট্রেড নেম, জেনেরিক নাম, মূল্য ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ উৎপাদন এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ছাড়া অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে আমদানির সুযোগ নেই। অথচ ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান উজালা পেইন্ট ট্রেডিং কোম্পানি ৩৭ ধরনের ওষুধের কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে আমদানি করেছে। এ ছাড়া ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই ধরনের ওষুধের কাঁচামাল আমদানির সুযোগ আইনত নেই। যদিও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি শুল্কায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে আটকে যাওয়ার পর নতুন করে ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে চালানটি খালাসের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। সরকারের নীতি আদেশ অমান্য করে বাণিজ্যিক আমদানিকারক এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতিরও চেষ্টা করেছে। আর এইচএস কোড অনুযায়ী, শুল্কায়ন করলে শুল্ক-করের পরিমাণ দাঁড়ায় আরও ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। কাস্টমসের পর্যালোচনা অনুযায়ী, চালানটির মোট শুল্ক-কর আসে ৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আর বাণিজ্যিক আমদানিকারকের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় অবাক খোদ কাস্টমস কর্মকর্তারাই। এ ছাড়া সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ধীরগতিতে নানা বির্তক তৈরি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন রংপুর ভ্যাটের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে বিল অব এন্ট্রিতে দেওয়া উজালা ট্রেডিং কোম্পানির রাজধানীর কদমতলীর দনিয়ার ঠিকানায় গিয়ে আমদানিকারকের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, এর আগে এক চালানেই ছয় হাজার কেজি সিলডেনাফিল সাইট্রেট (যৌন উত্তেজক ওষুধ ভায়াগ্রার কাঁচামাল) ধরা পড়েছিল বেনাপোল স্থলবন্দরে। এরপরও বিভিন্ন সময়ে ভায়াগ্রার কাঁচামাল দেশে ঢুকেছে। এটি ঢুকছে মূলত সোডিয়াল স্টার্চ গ্লাইকোলেট নামে। সিলডেনাফিল সাইট্রেট, যা মূলত ওষুধ উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে কিছু বিশেষ ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইদানীং কিছু কোমল পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কোমল পানীয় উৎপাদনে এ উপাদান ব্যবহার করছে বলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় আনা এ পণ্য ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক যৌন উত্তেজক ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় বলে জানা গেছে। এক ধরনের এনার্জি ড্রিংক তৈরিতে ভায়াগ্রার এ কাঁচামাল মেশানো হয়। এ ধরনের এনার্জি ড্রিংক সেবনকারী কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, কারও হার্টে বা ব্রেনে সামান্যতম সমস্যা থাকলে, ভায়াগ্রা সেবনে তার মৃত্যু অবধারিত। তাই নির্ধারিত (চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ) চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবেই ভায়াগ্রা সেবন করতে হবে। বাইপাস সার্জারি, ব্লাডপ্রেশার ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীরা ভায়াগ্রা সেবন করতে পারবেন না। ভায়াগ্রা কেউ বেশিদিন সেবন করলে আসক্ত হয়ে যায়। আর এটা ছাড়তে পারে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ভায়াগ্রা সেবন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি বলেও জানিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে লুৎফুল কবীর কালবেলাকে বলেন, ‘এটি নিষিদ্ধ নয়। তবে সবার জন্য আমদানি, উৎপাদন বা বিক্রি অনুমোদিতও নয়। যেহেতু সিলডেনাফিল একটি স্পর্শকাতর ওষুধ, তাই ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া আমদানির সুযোগ নেই। মিথ্যা তথ্যে যদি কেউ ৬ টনের মতো সিলডেনাফিল আমদানি করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এ ওষুধের ব্যবহার সীমিত। এই বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য আনা হতে পারে। বিশেষ করে তথাকথিত এনার্জি ড্রিংক, হারবাল কোম্পানির যৌন উত্তেজক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হতে পারে। মনে রাখতে হবে, সিলডেনাফিল ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগ নয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ওষুধ সেবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা এগুলো আমদানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও জানান এই চিকিৎসক।’
মন্তব্য করুন