ফিলিস্তিনের গাজায় শান্তি ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া পরিকল্পনা আংশিকভাবে মেনে নিতে সম্মত হয়েছে হামাস। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠনটি জানিয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি প্রদান ও গাজার শাসনভার হস্তান্তরের মতো শর্তগুলো মেনে নিতে রাজি আছে তারা, যদিও গাজায় বিদেশি শাসন নিয়ে আপত্তি থাকার কথা জানিয়েছে তারা। তবে আংশিকভাবে হলেও হামাসের ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গাজায় চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির গতিপথ বদলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা, যদিও ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার কিছু মৌলিক বিষয়ে এখনো ‘অস্পষ্টতা’ রয়ে গেছে। হামাসের এই সম্মতির বিষয়ে বিশ্বজুড়েও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া মিলেছে এবং জিম্মি মুক্তি ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। অবশ্য ইসরায়েলি হামলায় সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজার ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওয়াশিংটন সফরের সময় তার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এই পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার জন্য রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হামাসকে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন ট্রাম্প, অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন। তবে বেঁধে দেওয়া সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজার শাসনভার টেকনোক্র্যাটদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো মূল শর্তগুলোতে রাজি হওয়ার ঘোষণা দেয় হামাস, যাকে নাটকীয় অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনেক বিশ্লেষক। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও হামাসের এই বিবৃতিকে ইতিবাচক বলে স্বাগত জানিয়েছেন, যদিও তিনি হামাসের আলোচনার দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। একই সঙ্গে তিনি অবিলম্বে ইসরায়েলকে গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তার এই আহ্বানের পরও শনিবার ভোরে গাজায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকে, যেখানে অন্তত তিনটি স্থানে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে এবং গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ও হামাসের প্রতিক্রিয়া:
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল গাজায় সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করা এবং হামাসের হাতে আটক ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মি ও দুই ডজনেরও বেশি জিম্মির মৃতদেহ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেওয়া। বিনিময়ে ইসরায়েল তাদের কারাগারে আটক থাকা শত শত ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে। এ ছাড়া এই পরিকল্পনায় হামাসকে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে এবং গাজা শাসনে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে উল্লেখ করা হয়। পক্ষগুলো সম্মত হলে গাজায় ‘পূর্ণ মাত্রায়’ খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা পাঠানো এবং একটি আন্তর্জাতিক ‘শান্তি বোর্ড’-এর তত্ত্বাবধানে একটি ‘টেকনোক্রেটিক, অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটি’ দ্বারা গাজা উপত্যকার ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব বিষয়ে হামাস সম্মত হয়েছে তার অন্যতম জিম্মি মুক্তি ও শাসনভার হস্তান্তর। হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তাদের হাতে বন্দি থাকা সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। এ ছাড়া হামাস ‘ফিলিস্তিনি জাতীয় ঐকমত্য এবং আরব ও ইসলামী নেতাদের সমর্থনের ভিত্তিতে’ প্রস্তাবিত স্বাধীন ফিলিস্তিনি সংস্থার (যা টেকনোক্র্যাটদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে) কাছে গাজা উপত্যকার প্রশাসন হস্তান্তর করতেও রাজি থাকার কথা জানিয়েছে।
পাশাপাশি কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসারও দাবি জানিয়েছে হামাস। গোষ্ঠীটি তাদের বিবৃতিতে নিরস্ত্রীকরণের কথা উল্লেখ করেনি। হামাস কর্মকর্তা মুসা আবু মারজুক আল-জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা নিরস্ত্রীকরণের পথে হাঁটবেন না। এ ছাড়া গাজার শাসন ব্যবস্থায় ভবিষ্যতে আর কোনো ভূমিকা পালন করবে না—এমন কিছুও তারা তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করেনি। তবে হামাস গাজায় বিদেশি শাসন মেনে নেবে না এবং সেখানকার শাসনভার ফিলিস্তিনিদের দ্বারাই পরিচালিত হতে হবে বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে বিবৃতিতে। ট্রাম্প এই আলোচনার দাবিগুলো মেনে নেবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
বিশ্বনেতাদের ইতিবাচক সাড়া: ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার প্রতি হামাসের আংশিক সম্মতিকে বিশ্বনেতারা স্বাগত জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা অন্য যেসব বিষয়ে হামাসের সম্মতি আসেনি, সেগুলো নিয়ে আলোচনার ওপর জোর দিয়েছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজায় অবিলম্বে সংঘাতের অবসান ঘটানোর জন্য সব পক্ষকে এই সুযোগ কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেছেন, এটি যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর একটি সুযোগ তৈরি করেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান হামাসের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে স্থায়ী শান্তি অর্জনের দিকে একটি ‘গঠনমূলক এবং উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইন এই মুহূর্তটি কাজে লাগানোর ওপর জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন, ইউরোপ দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের সব প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে।
ইসরায়েল কী বলছে: হামাসের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অবিলম্বে বাস্তবায়নে ইসরায়েল প্রস্তুত হচ্ছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে (আইডিএফ) গাজা সিটি ‘দখলের’ তৎপরতা থামাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সামরিক তৎপরতা শুধু প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছে। তবে ইসরায়েল এখনো স্পষ্ট করে বলেনি যে হামলা পুরোপুরি বন্ধ হবে কি না। বরং, আইডিএফ ফিলিস্তিনিদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, উত্তর দিকে ওয়াদি গাজা এলাকা এখনো ‘একটি বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে রয়ে গেছে এবং সেখানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা ‘চরম বিপদ ডেকে আনছে’।
এদিকে, গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধে ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানানোর পরও ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকায় নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বেড়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের ইতিবাচক মন্তব্যে নেতানিয়াহু বিস্মিত হয়েছেন। কারণ, তিনি হামাসের বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাননি।
অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা: শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে হামাসের জবাবে যদিও কিছুটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তবে পরিকল্পনার মূল কয়েকটি বিষয় নিয়ে হামাস তাদের অবস্থান পরিষ্কার না করা সংঘাতে এরপর কী হতে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত নয়।
মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত নিরসনে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা অলিভার ম্যাকটার্নান বিবিসিকে বলেন, হামাস এখন ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছে যে তারা শান্তি পরিকল্পনার কিছু দিক নিয়ে আরও আলোচনার জন্য হামাসের আহ্বান মেনে নেবে কি না। তিনি বলেন, সহিংসতার জন্য কোন পক্ষকে দায়ী করা হচ্ছে তার দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে ট্রাম্প ইসরায়েলকে হত্যা বন্ধ করতে এবং গাজায় সাহায্য পাঠাতে বলার পাশাপাশি আরও আলোচনার অনুমতি দেওয়ার কথা বলবেন।
গাজা থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানান, গাজার মানুষ হতবাক এবং নাটকীয় ও দ্রুতগতির ঘটনাবলি বুঝতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গাজার ভেতর থেকে আমি শত শত বার্তা পেয়েছি, যেখানে প্রশ্ন করা হচ্ছে—যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেছে? এটি কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব? সেসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পেতে আমি হিমশিম খাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলি যুদ্ধ থামাতে সফল হবে কি না, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তবে যা স্পষ্ট তা হলো, গাজা যুদ্ধ একটি নির্ণায়ক মুহূর্তে প্রবেশ করেছে।’
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৬৬ জন নিহত: গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বোমা হামলার কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার হাসপাতালগুলোতে ৬৬ জনের মৃতদেহ এবং ২৬৫ জনকে আহত অবস্থায় আনা হয়। অ্যাম্বুলেন্স ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীরা পৌঁছাতে না পারায় এখনো অনেক ভুক্তভোগী ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে আছেন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নিহত ৬৬ জনের মধ্যে ২০ জন নিহত হয়েছেন গাজায় হামলা বন্ধ করতে ট্রাম্পের আহ্বানের পর চালানো হামলায়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনাহার এবং অপুষ্টির কারণে দুই শিশুর মৃত্যুর তথ্যও রেকর্ড করেছে, যার ফলে অপুষ্টিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে ১৫৪ জন শিশু।
মন্তব্য করুন