

দেশের রাজনীতি এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ এক বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি এবং গণভোটের সময়সূচি নিয়ে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক পক্ষ—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
গতকাল সোমবার এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। দলগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে। ফলে চলমান সংকট নিরসনের বল গড়াল দলগুলোর কোর্টে। অবশ্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বলেছে, সরকার চাইলে তারা আলোচনায় বসতে রাজি আছে, সেক্ষেত্রে সরকার বা প্রধান উপদেষ্টাকে ‘রেফারি’র ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যদিকে, সরকারকে দ্রুত দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে এনসিপি বলছে, দায়িত্ব নিয়ে সরকারকেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে।
এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা করাই হতে পারে এ কালো মেঘ দূর করার একমাত্র উপায়। এজন্য প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে উদারতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা এবং সবার মধ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের চেতনা।
৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশসহ ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। গত ১৭ অক্টোবর সংসদ ভবন চত্বরে জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। এরই মধ্যে ২৫টি দল ও জোট সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সুপারিশমালা নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। আর গণভোট হবে একটি প্রশ্নে। মূল সমস্যা তৈরি হয়েছে, দলগুলোর দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ গণভোটে না রাখার সুপারিশ নিয়ে। জামায়াত ও এনসিপি বিষয়টি ইতিবাচক মনে করলেও বিএনপি এটিকে রাজনৈতিক দল ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে দেখছে।
বিএনপি সাংবিধানিক সংস্কার সম্পর্কিত বিষয় নির্বাচিত সংসদের ওপর ছাড়তে চায় এবং গণভোটের দাবিকে তারা ‘কুতর্ক’ মনে করে। এরই মধ্যে দলটির নীতিনির্ধারকরা কমিশনের সুপারিশগুলো প্রত্যাখ্যান করে একে ‘প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যুক্তিসংগত নয়। বিএনপির অভিযোগ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালায় তাদের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে, গণভোটের প্রক্রিয়া এবং সংস্কারের বিষয়গুলো নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে না দিয়ে তড়িঘড়ি করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপির বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য চলতি নভেম্বর মাসেই গণভোটের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে দলটি। এসব বিষয়সহ মোট পাঁচটি দাবিতে জামায়াতসহ সমমনা আটটি দল আগামী বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দলগুলোর এমন পরস্পরবিরোধী অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের আদেশ ঘোষণা এবং সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়ে গণভোটের সিদ্ধান্ত নিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি সভায়’ এ সিদ্ধান্ত হয়। পরে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। অন্তর্বর্তী সরকারের বেঁধে দেওয়া সাত দিনের সময়সীমা একদিকে যেমন দ্রুত একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ‘অনড় অবস্থান’ দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক অচলাবস্থার স্পষ্ট পূর্বাভাস দিচ্ছে। সেইসঙ্গে এ সময়সীমার মধ্যেও প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে আসা পরস্পরবিরোধী বক্তব্যগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রাজনৈতিক আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ সহসা কাটছে না। ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বৃহৎ দলগুলো তাদের নিজস্ব দলীয় অবস্থানে অনড় থাকায় অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা বসে সমস্যা সমাধানে সরকারের বেঁধে দেওয়া সময় নিয়ে জানতে চাওয়া হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, সরকার চাইলে তারা আলোচনায় বসতে রাজি আছে। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে যেসব বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে আমাদের দলের মহাসচিবসহ অনেকেই এরই মধ্যে কথা বলেছেন। বিএনপির দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে। আসলে সংকট নিরসনের বিষয়টি একান্তই সরকারের দায়িত্ব। তারপরও আমরা (দলগুলোর সঙ্গে) কথা বলব।’
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সংবাদ সম্মেলনের পরপরই জামায়াতসহ সমমনা আটটি দলের শীর্ষ নেতারা এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে। এ সময় জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু একটা বিষয় যোগ করতে চাই, কারণ হচ্ছে উপদেষ্টা পরিষদ যদি এটা মনে করে যে তাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই, তারা কিছুই করবে না, দলগুলোই মিলে করবে, তাহলে এখানে একটা রেফারির অভাব হতে পারে। সে জন্য আমি বলছি, আমরাও চেষ্টা করব, উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে বিশেষ করে চিফ অ্যাডভাইজর (প্রধান উপদেষ্টা) এখানে একটা রেফারির ভূমিকা পালন করবেন আগের মতো, এটা আমি আশা করি।’ তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা বিএনপিকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আলোচনা বসার আহ্বান জানিয়েছি।’
অন্যদিকে এনসিপির দাবি, সরকারের ভেতরের কোনো একটা অংশ সংস্কারকে ভন্ডুল করে নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে। গতকাল বাংলামটরে দলটির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘সরকারের ভেতরের একটি পক্ষ নিজেরাই ঐকমত্য কমিশন হওয়ার চেষ্টা করছে। এ চেষ্টার কারণে নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই সরকার আদেশ জারি করবে, সেটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যখন সরকারের তরফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আরও এক সপ্তাহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাপ-আলোচনার কথা বলা হয়, তখন মনে হয়, সরকার আসলে এ সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে সাপ-লুডু খেলছে।’
আখতার হোসেন আরও বলেন, ‘আমরা ৯৬-তে পৌঁছে গিয়েছিলাম, সেটাকে আবার তিনে নিয়ে আসা হয়েছে সাপ কেটে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।’ দ্রুত সরকারকে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারকে নিজেকেই দায়িত্ব নিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। সামনের সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা প্রদান করার মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গণভোটের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের অভিপ্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন বাস্তবায়িত হয়, সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।’
‘বিভাজনের রেখা আরও তীব্র হচ্ছে’: সার্বিক বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা নিয়ে একটি পক্ষের প্রবল বিরোধিতা এবং অন্য পক্ষের দৃঢ় সমর্থন প্রমাণ করে যে, সংস্কার ও নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পরিবর্তে বিভাজনের রেখা আরও তীব্র হচ্ছে। দ্রুত এ বিভাজন দূর করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা না গেলে দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ আরও স্থায়ী হতে পারে। আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে দলগুলোকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতেই হবে। অন্যথায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে চেতনা তা হারিয়ে যাবে। এতে আমরা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
মন্তব্য করুন