

নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। তবে রায়ে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্বয়ংক্রিয় পুনঃস্থাপন হলেও এর বিধানাবলি শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর করা হবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরাতে করা আপিলগুলো মঞ্জুর ও রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় দেন।
সংক্ষিপ্ত রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘আদালত এই মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, পর্যালোচনাধীন আপিল বিভাগের রায়টি (বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের দেওয়া আগের রায়টি) কলঙ্কিত ও একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ। অতএব, পর্যালোচনাধীন রায়টি এতদ্বারা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হলো। ফলশ্রুতিতে, সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছেদ ২ক-এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিধানাবলি, যা সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ১নং আইন)-এর ধারা ৩ দ্বারা সন্নিবেশিত হয়েছিল, তা এতদ্বারা এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো।’
রায়ে বলা হয়, ‘যদিও এইরূপ পুনরুজ্জীবন পরিচ্ছেদ ২ক-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধানাবলির স্বয়ংক্রিয় পুনঃস্থাপন নিশ্চিত করে, তবে পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮খ (১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮গ (২)-এর বিধানাবলির প্রয়োগ সাপেক্ষে উহা কার্যকর হবে। পুনঃস্থাপিত ও পুনরুজ্জীবিত পরিচ্ছেদ ২ক-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধানাবলি কেবলমাত্র উক্তরূপ ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে। এ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ রায় পরবর্তী সময়ে প্রদান করা হবে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।’
রায়ের পর আপিলকারী আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্বহাল হওয়াটা সংবিধানের ৫৮ (খ) ও ৫৮ (গ) অনুচ্ছেদের প্রয়োগযোগ্যতা সাপেক্ষে কার্যকর হবে। ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এখন দেশে কোনো সংসদ নেই। সে কারণে তত্ত্বাবধায়কের বিধানের প্রয়োগযোগ্যতা নেই। তাই আদালত বলেছেন, ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে এই বিধানাবলি কার্যকর হবে। ফলে রায়ের মাধ্যমে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল হলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে। ভবিষ্যতে অর্থাৎ, ত্রয়োদশ সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গঠন করে চতুর্দশ নির্বাচন থেকে এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।’
রায় ঘোষণাকালে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আপিলকারী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শিশির মনির, সুজন সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার ও তার পক্ষে ড. শরীফ ভূঁইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
‘দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটবে’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ার পর দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটবে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে দেশের গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছিল। দেশের মানুষ ভবিষ্যতে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন। দিনের ভোট রাতে হবে না, মৃত মানুষ এসে ভোট দিয়ে যাবেন না। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সুপ্রিম কোর্টে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান।
দেশের বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট রায় দেয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তিনি সেটি মনে করেন না। কোন রায় রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট, আর কোন রায় আইনি ব্যাখ্যায় দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে, গণতন্ত্র রক্ষা করবে, মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করবে, আইনের শাসন রক্ষা করবে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্বহাল করবে, তা জাতি বিবেচনা করবে। আসাদুজ্জামান বলেন, আজকের রায়ে আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো। এটা কার্যকর হবে পরবর্তী সংসদ ভাঙার পরের ১৫ দিনের মধ্যে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা হয়েছিল। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না বলে তা সাংবিধানিক হিসেবেই রায়ে ঘোষিত হলো। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে ফুল জাজমেন্টে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার যে রূপরেখা আছে, তার পরিবর্তন সম্ভব হবে কি না—জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘পার্লামেন্টের কিছু ডিসকাশন থাকবে। ২০ বছর পর জনগণ যদি মনে করে এই ব্যবস্থা পচে গলে গেছে, এর থেকেও ভালো কোনো ব্যবস্থা গণতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন, তাহলে অবশ্যই পার্লামেন্টের ডিসকাশন থাকবে।’ একই আপিল বিভাগে তার আগের রায়কে কলঙ্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ বলার ব্যাখ্যা জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত বলেই ওই রায় বাতিল করা হয়েছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা কারণ ছিল, এই রায় লেখার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও তার সহযোগীরা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারায় অপরাধ করেছেন। গণতন্ত্রের স্বার্থে ভবিষ্যতে আবার এই রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য আসবে না বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
‘বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে’
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়কে দেশের জন্য মাইলফলক বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। জয়নুল আবেদীন বলেন, রায় ঘোষণার পর আজ মনে হচ্ছে ঈদের দিন। কারণ, একজন বিচারপতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। সংবিধান সংশোধন করেছে।
জয়নুল আবেদীন বলেন, আজকের রায়ের ফলে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। দেশের মানুষ এতদিন ভোট দিতে পারেনি। তারা এখন ভোট দিতে পারবে।
জয়নুল আবেদীন বলেন, আদালত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে এই রায় প্রসপেক্টিভ (ভবিষ্যৎমুখী)। বিএনপির পক্ষ থেকে তারা আগেই আবেদন করেছিলেন যে আপিল ও রিভিউ নিষ্পত্তির সময় আদালত যেন রায়টি প্রসপেক্টিভ বলে ঘোষণা করেন। সেই আর্গুমেন্ট আদালত গ্রহণ করেছেন। রায়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, বিএনপি এই রায়কে স্বাগত জানায়।
বিএনপির আবেদনের পক্ষে শুনানি করা সিনিয়র আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করেছিল। তারপর দেশের মানুষ আর ভোটাধিকারের সুযোগ পায়নি। ১৫৪ জন্য সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, দিনের ভোট রাতে হয়েছিল। আর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়টি তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন ছিল, যা আমরা আইন-আদালতের ভাষায় গ্রহণ করতে পারিনি।
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোয় পরিবর্তন আসতে পারে’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখায় আছে, সর্বশেষ সাবেক প্রধান বিচারপতি সরকারপ্রধান হবেন। যেহেতু এটি আগামী সংসদ থেকে কার্যকর হবে, তাই জুলাই সনদ পাস হলে সরকারের কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলার রায়ের পর শিশির মনির আরও বলেন, জুলাই সনদ চারটি অপশন দিয়ে গণভোটে পাঠানো হচ্ছে। এই চার অপশন গণভোটে পাস হলে এবং নতুন সংসদের সংবিধান সংস্কার সভায় গৃহীত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এটা নির্ভর করবে জুলাই সনদ গণভোটে পাস হলো কি না, আর পাস হওয়ার পর সংবিধান সংস্কার পরিষদ তা গ্রহণ করবে কি না তার ওপর। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে কার্যকর হবে জানিয়ে শিশির মনির বলেন, রায়ে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এখন যেহেতু সংসদ নেই, তাই এই বিধান আপাতত কার্যকর হবে না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি কার্যকর হবে না। এটি ভবিষ্যতে কার্যকর হবে।
‘সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান পুনরুজ্জীবিত করার রায়ে আনন্দিত সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, আপিল বিভাগের এ রায়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে রায় দিয়েছিলেন, তার মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। যার ফলে গত তিনটি নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পর আদালত রিভিউ পিটিশনটা গ্রহণ করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর থেকে এ বিষয়ে লেখালেখি অব্যাহত রেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এটি একটি অসাংবিধানিক রায় ছিল। এর পরবর্তী যে পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছে, সেটার ব্যাপারেও তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন।
‘কেন এখনই কার্যকর নয়’
পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা-সংক্রান্ত ৫৮গ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ ভেঙে দেওয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্ত হবেন উল্লেখ ছিল। অর্থাৎ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে। কাজেই ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পুনর্বহাল হলেও এখনই তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এ রায়ের আলোকে এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ নেই। কেননা, এক বছর আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পুনরুজ্জীবিত হলে চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ হবে। ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পুনর্বহাল হলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ গঠিত হবে, তা ভেঙে দেওয়ার পর সংশোধনীর আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যাবে।
মামলার পূর্বাপর
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় তিন দশক আগে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের চাপে এ সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। ওই বছর ২৭ মার্চ সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে। এ পদ্ধতির অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ১৯৯৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে আইনজীবী এম সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। শুনানির পর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।
পরে রিট আবেদনকারীরা ২০০৫ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১০ সালে আপিলে শুনানি শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালত এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি সে সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতি শুনানি গ্রহণ করেন। ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেন। এ ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে ছিলেন বিচারপতি খায়রুল হকসহ চারজন। আর তিনজন ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অর্থাৎ, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে তা বাতিলযোগ্য। তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ রায় ঘোষণার সাত দিন পর অর্থাৎ ১৭ মে অবসরে যান এ বি এম খায়রুল হক। অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে ‘তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।’ এ পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়া হয়। এ রায় প্রকাশের আগেই ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন এই সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে যে তিনটি নির্বাচন হয়, তার সবকটি পড়ে বিতর্কের মুখে। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। তৈরি হয় চরম রাজনৈতিক সংকট। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপই দেশে রাজনৈতিক সংকট নিয়ে এসেছে। ২০২৪ সালে জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট তার পতন ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ১৪ বছর আগের ওই রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে গত বছর আবেদন করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। এরপর রিভিউ আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আরেকটি রিভিউ আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন রায় নিয়ে আরেকটি আবেদন করেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠনও রিভিউ আবেদন করে। এ ছাড়া সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে এ মামলায় যুক্ত হয়।
গত ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদনগুলোর শুনানি শেষে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। এরপর পক্ষগুলো পৃথক পৃথক আপিল করে। গত ২১ অক্টোবর এসব আপিলের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২২, ২৩, ২৮, ২৯ অক্টোবর এবং ২, ৪, ৫, ৬ ও ১১ নভেম্বর শুনানি হয়। শুনানি শেষ করে রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। সে অনুযায়ী গতকাল রায় দেন আপিল বিভাগ।
কী ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনীতে
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ। সে জন্য সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইনের ২ ও ৩ ধারার মাধ্যমে সংবিধানে ৫৮ক, ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ অনুচ্ছেদ নতুন সন্নিবেশিত করার পাশাপাশি কয়েকটি অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন ও সংশোধন আনা হয়। আইনের ২ ধারার মাধ্যমে নতুন ৫৮ক অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়; আর ৩ ধারার মাধ্যমে নতুন ২ক পরিচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়। এ পরিচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বলা ছিল। এ-সংক্রান্ত ৫৮ক অনুচ্ছেদে পরিচ্ছেদের প্রয়োগ; ৫৮খ অনুচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার; ৫৮গ অনুচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, উপদেষ্টাদের নিয়োগ ইত্যাদি; ৫৮ঘ অনুচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যাবলি এবং ৫৮ঙ অনুচ্ছেদে সংবিধানের কতিপয় বিধানের অকার্যকারিতা সম্পর্কে বলা ছিল।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রায় দেওয়ার দেড় মাসের মাথায় ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়। তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে এ সংশোধনী পাস হয় সংসদে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এ সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। দেশের পটপরিবর্তনের পর পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট হয়। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর বিষয়টি আপিল বিভাগের হাতে ঝুলে ছিল। গতকাল আপিল বিভাগ এ ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিয়ে রায় দিয়েছেন।
মন্তব্য করুন