

ভোরে রান্নার জন্য চুলায় হাড়ি চাপিয়ে দিয়াশলাই জ্বালাতে যান গৃহবধূ আরনেজা বেগম। দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ; মুহূর্তেই পুরো রান্নাঘরে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। রান্নাঘরের সেই আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পাশের ঘরগুলোতেও। হঠাৎ লাগা এই আগুনে আরনেজাসহ দগ্ধ হন তার পরিবারের ঘুমন্ত সাত সদস্য। গতকাল শনিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পাকা মার্কেট সড়ক এলাকার টিনশেড একটি বাসায় এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। গ্যাসের পাইপলাইনের লিকেজ থেকে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে ধারণা পরিবারটির সদস্যদের।
অন্যদিকে, কাছাকাছি সময়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের একটি বাসায় গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের আরেকটি ঘটনায় একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হয়েছেন। উপজেলার পাটাত্তা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। দগ্ধদের স্বজনরা জানান, রান্নাঘরের পাইপলাইনের লিকেজ হওয়া গ্যাস ঘরে জমে ছিল। চার্জে দেওয়া মোবাইল ফোনের চার্জার বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আগুন মুহূর্তেই পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাসায় বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন দগ্ধ গৃহবধূ আরনেজার ছয় বছর বয়সী নাতনি ইভা ও ইশা, স্বামী মো. আব্দুল জলিল মিয়া, ছেলে আসিফ সাকিব ও আসিফের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মনিরা। এ ছাড়া এ ঘটনায় প্রতিবেশী ফিরোজুল আলমেরও শরীরের ২১ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন হারুনুর রশীদ বলেন, ‘জলিলের ১২ শতাংশ, আরনেজার ১০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। অন্যদের হাত-পা দগ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর হাত-পা দগ্ধ হয়েছে। তাকে চিকিৎসা দিয়ে গাইনি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। জলিল ও আরনেজা বেগমকে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অবজারভেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।’
দগ্ধদের হাসপাতালে নেওয়া জলিল মিয়ার জামাতা মো. আরফান মিয়া বলেন, ‘রাতে টিনশেড বাসায় পাশাপাশি ঘরে ঘুমিয়ে ছিল পরিবারের সাত সদস্য। ভোরের দিকে আমার শাশুড়ি আরনেজা বেগম রান্নাঘরে রান্না করতে যান। ম্যাচ (দিয়াশলাই) জ্বালাতেই টিনশেড বাসায় বিকট শব্দ (বিস্ফোরণ) হয়। এতে সাতজনই দগ্ধ হন। আমি ও আমার স্ত্রী জনিভা আক্তার পাশের ঘরে ছিলাম। আমাদের দুই মেয়ে ইভা ও ইশা তার নানার ঘরে ছিল।’
দুপুরে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নারী ও শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় দগ্ধদের কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে। তারা বলেন, আগুন লাগার পর দগ্ধদের চিৎকারে প্রতিবেশীরা এগিয়ে যায়। তাদের সহযোগিতায় দগ্ধদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
দগ্ধ আসিফ বলেন, ‘আগারগাঁও সরকারি কোয়ার্টারের বাসায় আমরা ভাড়া থাকি। দেড় মাস ধরে ঘরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। বাড়িওয়ালাকে বারবার বললেও শোনেনি।’
নারায়ণগঞ্জে চার্জার বিস্ফোরণের পর ঘরে আগুন: নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ঘরে আগুন লেগে নারী, শিশুসহ একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হয়েছেন। গতকাল ভোর সাড়ে ৪টার দিকে কাঁচপুর ইউনিয়নের পাটাত্তা এলাকার একটি বহুতল ভবনে এ ঘটনা ঘটে। দগ্ধরা হলেন ওই বাড়ির ভাড়াটে পোশাক কর্মী মো. আলাউদ্দিন (৩৫), তার দুই মেয়ে শিফা আক্তার (১৪), সিমলা আক্তার (৪) এবং আলাউদ্দিনের মা জরিনা বেগম (৬৫)। তাদের ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। আলাউদ্দিনের শরীরের ৪০ শতাংশ, সিমলার ৩০, জরিনা বেগমের ২০ ও শিফার ১২ শতাংশ পুড়েছে বলে জানান জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান।
জানা গেছে, ছয়তলা ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে দগ্ধ চারজন ভাড়া থাকেন। ভোরে চার্জে লাগানো অবস্থায় মোবাইল ফোনের চার্জারে বিস্ফোরণের পর আগুনের সূত্রপাত হয়।
দগ্ধ আলাউদ্দিনের বোন সালমা আক্তার বলেন, ‘রান্নাঘরের গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে ঘরে গ্যাস জমে ছিল। মোবাইল ফোনের চার্জার বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আগুন দ্রুত পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। ভোরে আলাউদ্দিন ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে, ঘরে ঢুকতেই আগুনে ঝলসে যান। একই সঙ্গে ঘরে থাকা মা ও দুই মেয়েও দগ্ধ হয়। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ থাকার কারণে তারা দ্রুত বের হতে পারেননি। প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।’
প্রতিবেশী শরিফ মিয়া বলেন, ‘মোবাইল ফোনের চার্জার বিস্ফোরণের পরপরই আগুন লেগে যায়। ঘরে সম্ভবত গ্যাস জমে ছিল, তাই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’
সোনারগাঁ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান খান বলেন, ‘কয়েকজন দগ্ধ হওয়ার খবর পাওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। কী কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, তা জানতে তদন্ত চলছে।’
এ প্রসঙ্গে কাঁচপুর ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস পরিদর্শক মেরাজ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ওই ঘরের একটি জানালার কাচ ভেঙে গেছে। ধারণা করছি, ঘরটি গ্যাসভর্তি ছিল। কোনোভাবে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিস্ফোরণে জানালার কাচ ভেঙে যায়।’
মন্তব্য করুন