মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় দেশের পাঁচটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) ২ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা আটকে আছে। রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত নেওয়ার অভিযোগে এ অর্থ আদায়ে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ), ভ্যাট। এর বিরুদ্ধে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আদালতে দ্বারস্থ হয়। আর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, রিপ্লেসমেন্টে গ্রামীণফোন ১ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৬৩৯টি সিম বিক্রি করে। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিপুলসংখ্যক এই সিম বিক্রির বিপরীতে সরকারকে কোনো ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক দেয়নি কোম্পানিটি। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায়ে ভ্যাট আইন-১৯৯১-এর ৫৫(৩) ধারা অনুযায়ী চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করে এলটিইউ ভ্যাট। তবে এ দাবির যথার্থতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করে গ্রামীণফোন। সেই মামলা এখনো নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভ্যাটের টাকা পায়নি এনবিআর। সর্বশেষ চলতি বছরের আগস্টে তারিখ থাকলেও মামলাটির শুনানি হয়নি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গ্রামীণফোনের কোম্পানি সচিব এস এম ইমদাদুল হকের মোবাইল ফোনে কল করা হলে আজম নামে এক কর্মকর্তা তা রিসিভ করেন। ভ্যাট-সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে কোম্পানির অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এনবিআরের এলটিইউ ভ্যাট সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণফোন ছাড়াও মামলার কারণে আরও দুটি মোবাইল ফোন অপারেটরের কাছে আটকে আছে ভ্যাটের ৪২১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো বাংলালিংক ও রবি আজিয়াটা। এর মধ্যে বাংলালিংকের করা ভ্যাট আপিলে আটকে আছে ২২৮ কোটি টাকার রাজস্ব। আগস্ট ২০০৬ থেকে মার্চ ২০০৭ পর্যন্ত সময়ে বিক্রি হওয়া সিম কার্ডের ওপর আরোপিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। একই কোম্পানির ভিন্ন একটি রিটে আটকে আছে ৯৪ কোটি টাকা। বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন ২০১৯ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে অবৈধ রেয়াত নিয়েছে বলে অভিযোগ এনবিআরের।
আর এই রেয়াত আদায়ে দাবিনামা জারি করে ভ্যাট কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে বাংলালিংক রিট করলে এনবিআরের দাবি করা পাওনা আটকে যায়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত বুধবার বাংলালিংকের করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স প্রধান তাইমুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, বিষয়টি ভ্যাট সম্পর্কিত হওয়ায় প্রধান হিসাব কর্মকর্তার (সিএফও) কাছ থেকে জানতে হবে। এ প্রতিবেদক এসএমএসের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠালে সিএফওর সঙ্গে কথা বলে জানাবেন বলে জানান।
এরপর পুরো বিষয়টি উল্লেখ করে এসএমএস পাঠানো হলেও তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। পরে তিনি এ প্রতিবেদকের ফোনও আর রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে ভ্যাট কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে অবৈধভাবে ভ্যাট রেয়াত নিয়েছে রবি আজিয়াটা। এর পরিমাণ ৯৯ কোটি টাকা। ভ্যাটের এ অর্থ আদায় করতে এনবিআরের এলটিইউ, ভ্যাট থেকে দাবিনামা জারি করা হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি আপিল করে। এখনো তা না হওয়ায় ঝুলে আছে ভ্যাটের এই বড় অঙ্কের অর্থ।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রবি আজিয়াটার দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এনবিআর সূত্র জানায়, আকিজ গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে আছে ৬১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে দ্বৈত মূসক চালান-১১ ব্যবহার করে ঢাকা টোব্যাকো ৫৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে এনবিআরের দাবি। একই গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন কম দেখিয়ে ৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এসব বিষয়ে এলটিইউ ভ্যাটের পক্ষ থেকে দাবিনামা জারি করা হলে প্রতিষ্ঠানগুলো আদালতের দ্বারস্থ হয়। আর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় সরকারের এ বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আটকে আছে।
এ ছাড়া পারটেক্স বেভারেজের কাছে মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে আছে সরকারের ১০৮ কোটি টাকা। এনবিআর বলছে, প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির তথ্য গোপন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা সেল সিআইসি এই ফাঁকির তথ্য উদ্ঘাটন করে। ওই কোম্পানির সঙ্গেও রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা চলমান।
মামলা-সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়ে কথা বলতে আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান এসকে নাসির উদ্দিনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ভ্যাটের ইস্যু নিয়ে কথা বলার বিষয়টি উল্লেখ করে মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠালে তিনি তা দেখেও কোনো জবাব দেননি।
এনবিআরের সদস্য ড. শহীদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বড় অঙ্কের রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মামলার তালিকা তৈরি করে প্রতিটি কমিশনারেটকে দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
মন্তব্য করুন