এ যেন শর্ষের মধ্যেই ভূত। প্রথমে দুদকের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভুয়া নোটিশ পাঠাত। পরে মীমাংসার নামে দাবি করত মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে ফাঁদে পড়ে ঠিক কতজন প্রতারণার শিকার হয়েছেন, তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। প্রতারণাকারী আর কেউ নন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ডিজির ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) গৌতম ভট্টাচার্য। ভুয়া নোটিশ দিয়ে ঘুষের টাকা লেনদেনের সময় গ্রেপ্তার গৌতমকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পরদিন গত শনিবার গৌতম ও তার সহযোগীদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে ডিবি।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযুক্ত গৌতম বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজন দুদক ডিজির পিএ হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে কমিশনে ব্যবহৃত চিঠির ফরম্যাট কিংবা খাম সবকিছুই ছিল তার হাতের নাগালে। এ ছাড়া নোটিশ কীভাবে লেখা হয়, কীভাবে পাঠানো হয়—সবটাই জানতেন তিনি। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সহযোগীদের দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও চাকরিজীবীকে টার্গেট করে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতেন। এরপর দুদকের চিঠির খাম ও প্যাডে সংস্থাটির ফরম্যাট ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিশ পাঠাতেন। পরে তাদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে বা সরাসরি দেখা করে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া বা সমঝোতার নামে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন। এভাবে অনেক ব্যবসায়ীকে নোটিশ পাঠিয়ে প্রতারিত করেছেন তিনি।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান কালবেলাকে জানান, গৌতম ও তার সহকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গৌতম চক্রের সঙ্গে দুদকের আর কেউ জড়িত কি না, তা-ও জানার চেষ্টা চলছে। তিনি ঠিক কতজনকে ভুয়া নোটিশ পাঠিয়েছিলেন সে বিষয়েও তদন্ত হচ্ছে।
অবশ্য ডিবির আরেক কর্মকর্তা জানান, এর আগে ২০২২ সালে দুই ব্যবসায়ীকে ভুয়া নোটিশ পাঠানোর কথা স্বীকার করেছেন গৌতম। তবে যারা ভুয়া নোটিশ পেয়ে টাকা দিয়েছেন হয়তো তাদেরও অনিয়ম রয়েছে। না হলে এভাবে টাকা দিতেন না। এজন্য ভুক্তভোগীদেরও খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছে।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডিবি কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার হাবিবুর রহমান জমি বেচা-কেনার দালালি করত। সে সূত্রে গৌতমের সঙ্গে পরিচয়। এরপর দুদকের ভুয়া চিঠি আদান-প্রদানের কাজ করত। তার দায়িত্ব ছিল নোটিশ পৌঁছানোর পর ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘাবড়ে দেওয়া। পরে গৌতমকে তাদের কাছে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
এর আগে গত শুক্রবার এক ব্যবসায়ীর অভিযোগের ভিত্তিতে এই চক্রের চার সদস্যকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে লালবাগ গোয়েন্দা পুলিশ। মো. আশিকুজ্জামান নামের ওই ব্যবসায়ীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে কার্পেট ও জায়নামাজের দোকান আছে। ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ তুলে তাকে দুদকের ভুয়া নোটিশ পাঠান গৌতম। এক পর্যায়ে ওই ব্যবসায়ীর সব সম্পত্তি ক্রোক বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে—এমন কথা বলে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ২ কোটি টাকা দাবি করে। এর মধ্যে ঈদের আগেই ২০ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানায়।
গোয়েন্দারা জানান, অভিযুক্তরা ওই ব্যবসায়ীকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বারবার চাপ দিতে থাকলে তার সন্দেহ হয়। তখন তিনি ডিবিকে ঘটনাটি জানান। পরে গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুদকের এমন কোনো চিঠি ইস্যুই হয়নি। এর পরই চক্রটিকে ধরার জন্য ফাঁদ পাতে পুলিশ। ভুয়া দুদক টিমের চাহিদা অনুযায়ী মিষ্টির চারটি প্যাকেটে দেড় লাখ টাকা ভরে পাঠানো হয় গৌতমের নির্দেশিত হোটেলে। সেখানে লেনদেনের সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয় গৌতমসহ চারজনকে। গ্রেপ্তার বাকি দুই প্রতারক হলেন চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য এসকেন আলী ও পরিতোষ মণ্ডল।
গৌতমসহ দুদকের তিন কর্মচারী বরখাস্ত : ‘ঘুষ লেনদেনের সময়’ হাতেনাতে গ্রেপ্তার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী গৌতম ভট্টাচার্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া প্রতারণার মাধ্যমে এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা দাবির অভিযোগে চট্টগ্রামে পুলিশের হাতে আটক দুদকের গাড়িচালক মো. সফিউল্লাহ ও কনস্টেবল ইমরান হোসেনকেও সাময়িক বরখাস্ত করেছে দুদক। গতকাল রোববার তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানিয়েছেন।
গতকাল দুদকের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত পৃথক আদেশে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন চাকরিবিধি ২০০৮-এর ৩৯ (খ) ৩৯ (ছ) ধারা অনুযায়ী চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
গত শুক্রবার মতিঝিলের একটি হোটেলে টাকা লেনদেনের সময় গৌতমসহ চারজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন এসকেন আলী খান, হাবিবুর রহমান ও পরিতোষ মণ্ডল। তাদের মধ্যে এসকেন আলী চাকরিচ্যুত পুলিশ কনস্টেবল।
মন্তব্য করুন