গুলশানে হলি আর্টিসান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ৭ বছরে এসে দেশে জঙ্গি কার্যক্রম অনেকাংশেই স্তিমিত। গত কয়েক বছর মাঠে সক্রিয় না থাকলেও জঙ্গি দমনে যুক্ত পুলিশের ইউনিটগুলো বলছে, হলি আর্টিসান বেকারিতে নৃশংসতা চালানো সেই নব্য জেএমবি এখন অনলাইনে সক্রিয়। তবে সংগঠনটির কারাবন্দি দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা কারাগারে বসেই সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে যে খবর আসছে, তা পুলিশের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ।
জঙ্গি কার্যক্রম নজরদারিতে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, প্রযুক্তিগত নজরদারি আর গোয়েন্দা
সূত্রে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে, কারাগারে বন্দি দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা নতুন ‘তানজিম’ খোলার চেষ্টা করছে। ভেতর থেকেই তারা বাইরে অবস্থানকারী নিজেদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। জঙ্গিদের ভাষায়, তানজিম অর্থ প্ল্যাটফর্ম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে—কারাগারে অবস্থানকারী নব্য জেএমবির জঙ্গিরা আদর্শগত ছাড় দিয়েও অপর নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গিদেরও একই প্ল্যাটফর্মে নিতে চায়। এ তানজিমের একটি অংশ চাচ্ছে, বাইরে থাকা অনুসারীদের দিয়ে আপাতত ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ ধর্ম প্রচার করে সাধারণ মুসল্লিদের সঙ্গে মিশে যেতে, পরিচয় গোপন করে আরও শুভাকাঙ্ক্ষি ও অনুসারী বাড়াতে। অপর একটি অংশ অবশ্য হার্ডলাইনে যেতে চায়। এ জন্য বিদেশে অবস্থানরত শুভাকাঙ্ক্ষি ও আগে যোগাযোগ হওয়া আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের খুঁজে বের করতে জোর দিচ্ছে তারা।
সূত্র বলছে, কারাবান্দিদের মধ্যে হার্ডলাইনে থাকতে চাচ্ছে নব্য জেএমবির দুর্ধর্ষ জঙ্গি শরীফুল ইসলাম খালেদ। কারাগারে বসেই ওই জঙ্গি টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে আফগানিস্তানে শুভাকাঙ্ক্ষিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। হলি আর্টিসান বেকারিতে মৃত্যুদণ্ডের আসামি এই খালেদ। অন্যদিকে ইকরাম, হাসিব ও ইরফান নামে কারাবন্দি কয়েক জঙ্গি চাচ্ছে ধর্মীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, নব্য জেএমবি নিয়ন্ত্রণে আছে। এ সংগঠনের অস্তিত্ব আছে বলে তিনি মনে করেন না। অনলাইন পেট্রোলিংয়েও এদের অস্তিত্ব খুব একটা নেই বলে তার দাবি। তিনি অবশ্য বলেন, নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।
কারাবন্দি জঙ্গিদের ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন (উগ্রবাদবিরোধী উদ্বুদ্ধকরণ) বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, আপাতত বাইরে এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যে কারাগারে বন্দি জঙ্গিদের জন্য এ কার্যক্রম চালু করা হতে পারে।
জানা গেছে, হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া নব্য জেএমবির সাত জঙ্গিসহ অন্যান্য সংগঠনের দুর্ধর্ষ জঙ্গি গাজীপুরে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে রয়েছে। কারাগারে বসে এই জঙ্গিদের প্ল্যাটফর্ম গড়ার চেষ্টা এবং বাইরে প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাই সিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা কালবেলাকে বলেন, ‘কারাগারে জঙ্গিদের আলাদা সেলে রাখা হয়। একজন আরেকজনের সঙ্গে বসে শলাপরামর্শ করার সুযোগ নেই। সব সময়েই অতিরিক্ত নজরদারিতে থাকে জঙ্গিরা।
তিনি দাবি করেন, কারাগার থেকে বাইরে ফোনে কথা বলা বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে কথা বলার সুযোগ নেই।
দেশে জঙ্গি কার্যক্রম নজরদারি ও গবেষণায় যুক্ত বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, আপাতত নব্য জেএমবির হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। বৈশ্বিকভাবে জঙ্গিবাদ স্তিমিত, দেশে টানা অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়া, কড়া নজরদারি এবং অর্থের জোগান সীমিত হয়ে পরায় ২০১৬ সালে নৃশংসতা চালিয়ে দেশ-বিদেশের নজরে আসা নব্য জেএমবিও কোণঠাসা। তবে এরা অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে নানা বেশে, নানা পরিচয়ে।
দেশে জঙ্গি কার্যক্রম নজরদারি ও বিশ্লেষণ করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তিনি কালবেলাকে বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রমের লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে। গত ৭ বছরে নব্য জেএমবির এমন তৎপরতা চোখে পড়েনি যে নতুন করে সংগঠিত হওয়া বা হামলার চালানোর সক্ষমতা এদের রয়েছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক উগ্রবাদের ঢেউ এবং জঙ্গিরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সমর্থন বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি এও বলেন, দেশে অপারেশনাল কার্যক্রম চালিয়ে উগ্রবাদীদের থামানো গেলেও দীর্ঘমেয়াদে সামাজিকভাবে এদের নিবৃত্ত করার কার্যক্রমটা ঢিলেঢালা রয়ে গেছে। এখন জঙ্গিদের ডি-র্যাডিক্যালাইজড করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ কালবেলাকে বলেন, নব্য জেএমবির কার্যক্রম সীমিত হয়ে আছে, এটা সাদা চোখে বলা গেলেও এরা একটা আদর্শ নিয়ে কার্যক্রম চালায়। এ জন্য এদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর হলে এরা চুপ থাকে। তখন সদস্য সংগ্রহে নীরবে নানা কার্যক্রম চালায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে ঢিলেমি হলেই তাদের আসল রূপ দেখা যায়। তিনি বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো সবসময়েই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। এ জন্য অর্থ সংগ্রহ করবে, সদস্য সংগ্রহ করবে। সেটা করতে পারলে হয়তো নৃশংসতা চালানোর চেষ্টা করবে। এ জন্যই আমাদের সব সময়ে নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে, যেটা পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো ভালোভাবেই করতে পারছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, নব্য জেএমবির অবস্থা নড়বড়ে বলেই মনে করা হয়েছে। তবে নানা তথ্য বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, এরা নতুন কোনো প্ল্যাটফর্ম গড়ার চেষ্টা করছে।
নব্য জেএমবির ‘সর্বশেষ’ আমীর মাহাদী হাসান কোথায়? : সিটিটিসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত নব্য জেএমবির কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা অভিযানে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী ও সরোয়ার জাহান মানিক নিহত হওয়ার পর কোণঠাসা হয়ে যায়। ২০২০ সালে বিদেশে অবস্থান করা মোহাম্মদ কামরুল হাসান ওরফে মাহাদী হাসান জন সংগঠনটির আমির নিযুক্ত হয়। পরে ওই ব্যক্তি ‘আবু আব্বাস আল বাঙালী’ নাম দিয়ে সংগঠনটির পক্ষে ইন্টারনেটে নানা প্রচার চালাতে থাকে। পরে সিটিটিসি তুরস্কে ওই ব্যক্তির অবস্থান শনাক্ত করে। সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, সিটিটিসির তথ্যে তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে মাহাদীকে গ্রেপ্তার করে। অবশ্য সে বর্তমানে জামিনে রয়েছে। তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই জঙ্গির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। তাকে দেশে ফেরানোর সব চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সেই ভয়ংকর রাত : ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানে অবস্থিত হলি আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি থেকে বেরিয়ে আসা অতি উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী ‘নব্য জেএমবি’ ওই নৃশংসতা চালায়। ওই হামলায় পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ জন নিহত হন। নিহত বিদেশি ১৭ জনের মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানিজ এবং একজন ভারতীয়। অন্য ৩ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এবং অন্য দুজন বাংলাদেশি। অপর দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। ওই হামলার ঘটনায় দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
ওই নৃশংসতার পর হলি আর্টিসানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ড’ নামে সেনা অভিযানে সরাসরি হামলায় যুক্ত পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। পরে পুলিশি তদন্তে হামলায় নানাভাবে যুক্ত আরও ২১ জঙ্গির সম্পৃক্ততা মেলে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা অভিযানে বিভিন্ন আস্তানায় ১৩ জঙ্গি নিহত হয়। ওই ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বিচার কার্যক্রম শেষে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর নিম্ন আদালত নব্য জেএমবির জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেন। অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেন আদালত। তবে উচ্চ আদালতে ওই আসামিদের এখনো চূড়ান্ত বিচার সম্পন্ন হয়নি।
মন্তব্য করুন