মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৩, ০৯:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আগ্রাসী হয়ে উঠছে ডেঙ্গু

তিন দিনে ৯ মৃত্যু
এডিস মশা। ছবি: সংগৃহীত
এডিস মশা। ছবি: সংগৃহীত

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বাড়ছে বৃষ্টিপাত। বাসা-বাড়ির আঙিনায় কিংবা আনাচে-কানাচে জমে থাকা পানিতে এখন এডিস মশার লার্ভা। ফলে হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর। ছয় মাসে ডেঙ্গু ৫২ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২৩ বছরেও পুরোনো রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। উল্টো শক্তভাবেই শিকড় গেড়েছে। ফলে শহুরে ডেঙ্গু এখন গ্রামেও সমান দাপট বিস্তার করেছে; কিন্তু ডেঙ্গু মোকাবিলায় কীটতত্ত্বভিত্তিক স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি কোনো পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি। এখনো সিটি করপোরেশনের সীমিত পরিসরে মশক নিধন আর স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসা সম্প্রসারণে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ফলে এ সুযোগে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে গত তিন দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ডেঙ্গুতে ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ৯ হাজারেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ছয় মাস ধরা হয় ডেঙ্গু মৌসুম। সে হিসাবে আরও চার মাস ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এবার বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শুধু চিকিৎসাসেবার পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে ডেঙ্গু নির্মূল কিংবা মোকাবিলা সম্ভব নয়। কীটতত্ত্ববিদদের নেতৃত্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়াও নগরায়নের প্রভাবে সৃষ্ট ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়। বরং ধীরে ধীরে শহর থেকে গ্রামে ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

এদিকে বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত উভয়ই বাড়ছে। ফলে দেশের শহরাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য।

এ রোগে প্রতি বছর যতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়, তার ২৫ শতাংশ হয় বর্ষাকালে। আর শীতকালে হয় ১৪ শতাংশ। এ তথ্য বলে দিচ্ছে, বর্ষার মাত্রা বাড়লে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালবেলাকে বলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যা দেখছি, ধীরে ধীরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিস্থিতি খারাপ হবে যদি আমরা ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি। নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে হটস্পট ম্যানেজমেন্টে। যে এলাকায় ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে, সেখানে ফগিং করতে হবে। যেখানে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেনি সেখানে এডিসের লার্ভা যেন না জন্মাতে পারে সে জন্য কাজ করতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে। সরকারি কর্মসূচিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ কাজগুলোকে সঠিকভাবে করতে পারলে হয়তো ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে রাখা যাবে। নয়তো বাড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইতোমধ্যে দেশের ৫২ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়নি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। ২০০০ সালে সর্বপ্রথম দেশে ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয়। সে বছর ৯৩ জন মারা যান। ৩ বছর পর মৃত্যুসংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তবে ২০১৮ সালে ডেঙ্গু আবার ফিরে আসে। সে বছর জ্বরটিতে ২৬ জন মারা যায় এবং ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হন। ২০১৮-এর আগে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে। সে বছর সারা দেশে ৬ হাজার ২৩২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ২০১৯ সালে। সে বছর রাজধানীসহ সারা দেশে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। সরকারি হিসাবে মারা গিয়েছিল ১৬৪ জন। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ছিল ৩৩ জন। ২০১৭ সালে তা বেড়ে গিয়ে হয় ১৮৬ জন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫২ জন। ২০২২ সালে দেশে ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ সময়ে ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী মাসে বাড়বে বৃষ্টি। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপে হাসপাতালে রোগী এবং এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

২০০৭ সাল থেকে চার বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ডা. এ কে এম মোয়াজ্জেম হোসেন। সে সময়ে ডেঙ্গুর মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। তিনি কালবেলাকে বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমি রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সে সময়ে দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমেছিল। এ জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা কাজে স্কাউটস ও গার্লস গাইডকে কাজে যুক্ত করেছিলাম। সারা দেশে তারা গণসচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করে। ফলে দেশের মানুষ সচেতন হয়। ডেঙ্গুর প্রকোপও কমে আসে। এখন ডেঙ্গু মোকাবিলায় এসব কার্যক্রম আর নেই। স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আবার জনসম্পৃক্ত কার্যক্রমে ফিরে যেতে হবে। তবেই ডেঙ্গু মোকাবিলা সম্ভব হবে। নয়তো শুধু ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলা সম্ভব হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সেভাবে করা হচ্ছে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় ওষুধ মাত্র একটি উপাদান বা উপায় মাত্র; কিন্তু সব পদ্ধতিতে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কাজ না করলে তো সফলতা মিলবে না। এটা নিয়ন্ত্রেণের জন্য একটা কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা লাগবে। কীটতত্ত্ববিদ লাগবে। গবেষণাগার লাগবে। যন্ত্রপাতি, কীটনাশক লাগবে। এসব কিছুর সফল প্রয়োগে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। আমরা শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলার চেষ্টা করছি। তাই সফল হচ্ছি না। গত ২৩ বছরে ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছি। আগামী ২০ বছরেও মনে হয় না এই পদ্ধতিতে সফল হবো। উল্টো রোগটি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছি। জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে; কিন্তু রাজধানীর মতো তো জেলা শহরের সক্ষমতা নেই। ফলে গ্রামেও এ রোগটি দাপটের সঙ্গে বিস্তার লাভ করছে। প্রান্তিকে চিকিৎসায়ও দুর্বলতা আছে, ফলে প্রান্তিকে এখনো মৃত্যুও বেশি হচ্ছে।

দেশের সর্বশেষ অবস্থা

এদিকে গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের মৃত্যু হয়। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল সারা দেশে ৪৩৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

অধিদপ্তরের তথ্য ইউনিটের (এমআইএস) ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১ হাজার ৫৩১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৩টি হাসপাতালে ১ হাজার ২২ জন এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য বিভাগে ১ হাজার ৫০৯ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৯ হাজার ১৯৩ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শুধু ঢাকা মহানগরে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৫৫ জন; ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৫৩৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। গতকাল মৃত্যু হওয়া চারজনকে নিয়ে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫৬ জনের।

মাস হিসাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ১০৩৬, জুনে ৫৯৫৬, জুলাইয়ে গত তিন দিনে ১২১৫ জন। এদিকে চলতি বছরের প্রথম মৃত্যু হয়েছে জানুয়ারি মাসে। তখন ৬ জনের মৃত্যু হয়। ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে দুজন, জুনে ৩৪ জন এবং জুলাইয়ের গত তিন দিনে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আফগানিস্তানে কেন বারবার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানছে

সাদাপাথরে যে সৌন্দর্য ফিরবে না আর

আগস্টের ৩০ দিনে রেমিট্যান্স আসেনি ৯ ব্যাংকে

বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে ঢাকা

মাথায় টাক হতে পারে ৫ ধরনের অসুখের লক্ষণ

৪৭তম ট্রফি জেতা হলো না মেসির, ফাইনালে মায়ামির লজ্জার হার

১৩০ বছরের ‘জিয়া বাড়ি’ আজও অবহেলিত

ফের আলোচনায় ভারতের সুপার স্পাই অজিত দোভাল

বিবিসি নাকি ভাই ভাই চ্যানেল, নারী সংবাদিক ভাইরাল

সুস্থ থাকতে রাতে ভাত খাবেন, না রুটি? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

১০

তাহসানের সংগীতের রজতজয়ন্তী পালন হবে অস্ট্রেলিয়ায় 

১১

পাকিস্তানের বিপক্ষে শি জিনপিংয়ের সহায়তা চাইলেন মোদি

১২

১ সেপ্টেম্বর: কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

বিদ্যুৎ কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

১৪

ডিএমপির দুই অতিরিক্ত কমিশনারের দপ্তর বদল

১৫

মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে যে জেলায়

১৬

উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট ফেলোশিপ পেলেন মহিলা দল নেত্রী সুমাইয়া

১৭

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে বড় নিয়োগ

১৮

আজ বিশ্ব চিঠি দিবস : হারিয়ে যাওয়া আবেগের দস্তাবেজ

১৯

বিতর্কিত পেনাল্টির পরও রায়োর সঙ্গে বার্সার ড্র

২০
X