রাজধানীর ধানমন্ডির ৯/এ। জিগাতলা থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে যেতে হাতের বাঁ পাশে তাকালেই চোখে পড়ে ১৬তলা একটি আলিশান ভবন। নাম গাউছিয়া টুইন পিক। ১৬তলা বিশিষ্ট এই ভবনের প্রথম এবং দ্বিতীয় তলায় কয়েকটি কাপড়ের দোকান এবং শোরুম। এরপর তৃতীয় তলা থেকে শুরু করে পুরো ১৬তলা পর্যন্ত রয়েছে অন্তত দেড় ডজন রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে ছয়টি বড় বাফেট লাউঞ্জ। বাকিসব চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। এসব রেস্টুরেন্টের রান্নাও করা হয় এ ভবনেই। তবে নেই ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। কয়েকটিতে দু-একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও কর্মচারীরা জানেন না ব্যবহারবিধি। এমন অন্তত সাত-আটটি ভবন রয়েছে ধানমন্ডিতেই। এ ছাড়া জিগাতলা থেকে শংকর মোড় পর্যন্ত সাতমসজিদ রোডের দুই পাশে অন্তত শতাধিক আবাসিক ভবনে রয়েছে কয়েকশ বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্ট। গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিন এসব রেস্টুরেন্টে ঘুরে মাত্র একটি রেস্টুরেন্টের ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন দেখা গেছে। কয়েকটি রেস্টুরেন্ট অনুমোদন আছে জানালেও কেউ নথি দেখাতে পারেনি। সরকারি কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই চলছে এসব রেস্টুরেন্ট। একেকটি রেস্টুরেন্ট যেন একেকটি নীরব বোমায় পরিণত হয়েছে।
ধানমন্ডির ১৫/এ-তে এমন একটি ভবন রয়েছে, যার স্থপতি মুস্তাফা খালিদ। তিনি গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অনুরোধ করেছেন কেউ যেন ওই ভবনে না যান। কারণ হিসেবে বলেছেন, ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, নকশা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিকভাবে একে সমূহ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। কেবল এই ভবনটিই নয়।
সরেজমিন গতকাল শুক্রবার ঝিগাতলা গিয়ে দেখা যায়, সাত মসজিদ রোডের ৪২নং হাউস। পঞ্চম তলা এই ভবনটির নিচে একপাশে অ্যাপেক্সের শোরুম। অন্যপাশে পুরো ভবনেই রয়েছে রেস্টুরেন্ট। ছাদের উপরে বানানো হয়েছে রুফটপ। এই ভবনের নিচে ডানপাশে ইয়োমমো নামের একটি রেস্টুরেন্ট। দ্বিতীয় তলায় খানাস রেস্টুরেন্ট, তৃতীয় তলায় স্লাইস, চতুর্থ তলায় টেরিয়াকি ও পঞ্চম তলায় ক্যাফে অ্যাপোলিয়ানো নামের একটি রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টটি ছাদের ওপরে রুপটপ বানিয়েছে। গতকাল বিকেলে খানাসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মো. শরিফুল ইসলাম, স্লাইসের ম্যানেজার মো. শাহরিয়ার, টেরিয়াকির সুপারভাইজার রিকি পেট্রিক গোমেজ এবং ক্যাফে অ্যাপোলিয়ানোর ম্যানেজার মো. আফিফের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। ক্যাফে অ্যাপোলিয়ানোর কোনো ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন নেই, নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। তারা আবেদন করেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে রেস্টুরেন্টটি চলছে গত এক বছর ধরে। বাকিগুলোতে দু-একটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করতে জানেন না কর্মচারীরা। আর ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন আছে জানালেও কেউ দেখাতে পারেননি। এই ভবনটিতে প্রবেশের সিঁড়ি রয়েছে মাত্র একটি। নেই কোনো ইমার্জেন্সি সিঁড়ি। সিঁড়ির সাইজ খুবই ছোট। কোনোরকম একসঙ্গে দুজন যাতায়াত করতে পারেন। তবে স্বাস্থ্যবান হলে একজনের বেশি হাঁটাচলা করা যাবে না। একটি লিফট থাকলে কোনোরকম তিনজন ব্যবহার করা যায় লিফট। এই ভবনের নিচে নেমে সিঁড়ির কাছে দেড় ফুট চওড়ার একটি চেম্বারে গাদাগাদি করে ১৮টি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা। এসব গ্যাস সিলিন্ডার থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস যায় উপরের রেস্টুরেন্ট। এরপর সেখানে হয় রান্নাবান্না। এই ভবনটির পাশেই গ্রিন আকাশী প্লাজা নামের একটি ভবনে রয়েছে সুলতান ডাইনস এবং মিনুস কিচেন নামের দুটি রেস্টুরেন্ট। এরপর একটি গলি ঝিগাতলার ভেতরের দিকে গেছে। এই গলির পরেই রয়েছে গ্রিন আকাশী প্লাজা নামের আরও একটি ভবন। এই ভবনটিতে রয়েছে ১০টি রেস্টুরেন্ট। এই ভবনের নিচতলায় রয়েছে আফতাব রেস্টুরেন্ট। দ্বিতীয় তলায় উনান রেস্টুরেন্ট, তৃতীয় তলায় স্বদেশী, সি মাইনর ক্যাফে ও গেমলার্স, চতুর্থ তলায় প্লাটিনাম ক্লাব, পঞ্চম তলায় ক্যাপিটাল লাউঞ্জ, ষষ্ঠ তলায় পার্কি এনস্মার্ক, সেভরি গ্রিন ক্যাফে এবং ক্যাফে ইউফোরিয়া। এই ভবনের গেমলার্সের ম্যানেজার মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ফায়ার অনুমোদনে আছে দাবি করলেও কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এ ছাড়া উনার রেস্টুরেন্টে গিয়ে ম্যানেজার মো. বরকত এবং মো. রাকিবুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। এই রেস্টুরেন্টের ভেতরে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আর একটু সামনে এগোলে আরেকটি ভবনে কাসুন্দি, গ্রিলার্স, জিনজিয়ান নামে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এরপর সেবা ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাপরিকা, তৃতীয় তলায় দি কফি বিন অ্যান্ড টি লাফ ও ক্যাফেলাইটিক্স নামে রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই রেস্টুরেন্টগুলোরও নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। এরপর থানমন্ডি ৯/এ। এখানে কেবিস্কয়ারের প্রায় পুরোটজুড়েই রয়েছে রেস্টুরেন্ট। এই ভবনের সামনে সাঁটানো তালিকা অনুযায়ী এখানে দ্বিতীয় তলায় ক্যাফে হ্যালো থানমন্ডি, তৃতীয় তলায় বিনদিয়া এক্সক্লুসিভ (টেকআউট), চতুর্থ তলায় দ্য ভাপিয়ানো ক্যাফে অ্যান্ড মোর রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এ ছাড়া এই ভবনের তৃতীয় তলায় ইজ এবং ওজং নামে দুটি রেস্টুরেন্ট। পঞ্চম তলায় মেসেপ। উপরের দিকে মুনচেরি, আর্ট অব ফুড, ঘুহা, টেস্টি ব্লাস্ট, গ্র্যান্ড হাউস, ব্ল্যাক পেপাপ নামে রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এরপর গাউছিয়া টুইন পিক নামে একটি ভবন। এই ভবনের পুরোটাজুড়েই রয়েছে অন্তত ২০টি রেস্টুরেন্ট। যার মধ্যে রয়েছে ছয়টি বাফের লাউঞ্জ। এই ভবনে প্রথম তলায় কয়েকটি কাপড়ের দোকান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখা রয়েছে। এরপর দ্বিতীয় তলা থেকে শুরু করে পুরো ১৬ তলা পর্যন্ত রয়েছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট। সরেজমিন দেখা যায়, এই ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ক্যাফে ডলস, তৃতীয় তলায় ক্যাফে সাও পাওলো ও আদি কড়াই গোস্ত, চতুর্থ তলায় ইয়াম চা ডিস্ট্রিক ও দ্যা লবি বাফেট, পঞ্জম তলায় অ্যারিস্টোক্রেট লাউঞ্জ, ষষ্ঠ তলায় হোয়াইট হল, সপ্তম তলায় মেরিটেজ ঢাকা, অষ্টম তলায় দ্যা প্যান পেসিফিক লাউঞ্জ, নবম তলায় স্পাইস অ্যান্ড হেয়ার এবং কালচার অ্যান্ড ইনসাইন, দশম তলায় চাপ ঘর, এগারোতম তলায় কাভান সিগনেচারসহ আরও কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই ভবনের হেড ইলেকট্রিশিয়ান মো. সুমন আলীর সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তিনি বলেন, এটি আবাসিক ভবন হলেও পরবর্তী সময়ে রেস্টুরেন্ট বানানোর জন্য অনুমোদন আনা হয়েছে। এই ভবনে ইমার্জেন্সি একটি সিঁড়ি থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। এই ভবনের অন্তত পাঁচটি রেস্টুরেন্ট। তারা কেউই ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনপত্র দেখাতে পারেননি। ভবনের পাশে খোলা জায়গায় ৪০ থেকে ৫০টি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা। সেখান থেকে লাইনের মাধ্যমে পুরো ভবনে সরবরাহ করা হয় গ্যাস। তবে ওই সিলিন্ডার রাখার জায়গায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। উন্মুক্ত স্থানে এভাবে সিলিন্ডার রেখে ব্যবহার করায় আতঙ্কে রয়েছেন আশপাশের বাসিন্দারা।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ১০ তলার ওপরে আবাসিক বা বাণিজ্যিক যে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে ব্যবহারের জন্য দুটি সিঁড়ি প্রদর্শন করে বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী নকশার অনুমতি নিতে হয়। ১০ তলার নিচে বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। অনুমোদন নিতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, দুর্ঘটনার সময় মানুষ কীভাবে আসবে-যাবে, তা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক। তবে সমস্যা দেখা যায়, অনেক সময় ভবনগুলো আবাসিক আকারে কিংবা অফিস স্পেস হিসেবে একটি সিঁড়ি প্রদর্শন করে নকশার অনুমোদন নেয়।
নির্মাণ শেষে ৬ মাস এক বছর সময়ের মধ্যে আবাসিক হিসেবে অনুমোদন নেওয়া ভবন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু হয়। বেশি ভাড়া পাওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে রেস্টুরেন্ট বা আবাসিক হোটেলে হিসেবে রূপান্তর করতে মালিকরা আগ্রহ দেখান। বিশেষ করে ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোড, মিরপুর রোড, খিলগাঁও এলাকা বনানী ১১ নম্বর রোড, গুলশান অ্যাভিনিউ রোডে বেশিরভাগ ভবন বাণিজ্যিক স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অধিকাংশই রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) মো. আনোয়ারুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘থানমন্ডির অনেক ভবনেই আমাদের অগ্নির ঝুঁকির নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগামী রোববার আমার সব ইন্সপেক্টরকে ডেকেছি। সোমবার থেকে স্পেশেফিক শুধু রেস্টুরেন্টগুলোতে অভিযান চালানো হবে।