সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলন এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা। বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর জোট নেতাদের প্রত্যাশা ছিল, একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে তারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অভিন্ন দাবিতে পরিচালিত যুগপৎ আন্দোলনে যেটা সহায়ক হতো। কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়ে তারা কার্যত চুপ হয়ে যায়। জোট নেতারা মনে করছেন, যেটা ছিল অনেকটা ‘গাছে তুলে দিয়ে মই টেনে নেওয়া’র শামিল। গত শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠকে এমন হতাশা প্রকাশ করেন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ১২ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতা। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। তবে এটাকে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলছেন জোট নেতারা।
যুক্তরাষ্ট্র এবার বাংলাদেশে অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ইস্যুতে বেশ আগে থেকেই সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত। এর অংশ হিসেবে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে বলে দাবি তাদের। এ নীতির অধীনে বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। মার্কিন এই পদক্ষেপ তখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের জন্য সহায়ক ছিল বলে বিএনপি ও জোটের অনেক নেতার দাবি। তখন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অনেক
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেন তিনি। নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট নিরসনে পিটার হাস তখন ‘দূতিয়ালির ভূমিকা’ পালন করেন বলে অনেকের অভিমত। একপর্যায়ে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনার জেরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তারে বিএনপির অন্য নেতারা আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নভেম্বরে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় বিএনপির নেতাকর্মীরা তখন ঝটিকা মিছিলে আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে বাধ্য হন। কিন্তু তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা ছিল কার্যত নীরব। পিটার হাসের ওই ভূমিকায় জোট নেতারা ব্যক্তিগত ও ঘরোয়া আলোচনায় হতাশা প্রকাশ করেন। নেতাদের দাবি ছিল, বিএনপিকে ছাড়া অনুষ্ঠিত ‘একতরফা ও ডামি’ নির্বাচন গণতান্ত্রিক বিশ্ব—বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে নির্বাচনের পর নতুন সরকারের ওপর কোনো পদক্ষেপ আসতে পারে। এমনটা হলে উদ্ভূত পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে ফের জোরালো আন্দোলনে সরকারকে চেপে ধরা হবে। সব মিলিয়ে তখন সরকার আর টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু তেমন কোনো কিছুই হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মনোভাবও এখন নমনীয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এজন্য অবশ্য বিএনপির কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে জোটের অনেক শরিক।
সূত্র মতে, বৈঠকের শুরুতে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় কী হতে পারে, কীভাবে আন্দোলনকে আরও গতিশীল করা যায়—সে ব্যাপারে ১২ দলীয় জোট নেতাদের পরামর্শ চান মির্জা ফখরুল। এরপর জোট নেতারা একে একে তাদের অভিমত, প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
বৈঠকে নির্বাচনের আগে ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন ১২ দলের নেতারা। কেউ কেউ বলেন, সরকারের ধারাবাহিক দমননীতির আলোকে তপশিলের আগে কয়েক লাখ মানুষের এত বড় সমাবেশ নিয়ে বিএনপির আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকার যে কোনো মূল্যে সমাবেশ পণ্ড করে দিতে পারে, আগে থেকেই এমন শঙ্কা ছিল। সে বিবেচনায় সমাবেশকে ঘিরে বিএনপির ‘প্ল্যান-বি, সি’ রাখা উচিত ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। তা ছাড়া পুলিশ তাণ্ডব চালিয়ে সমাবেশ পণ্ড করে দিয়ে বিএনপির ওপর তার দায় চাপায়। কিন্তু পক্ষান্তরে সরকারের এই অপপ্রচার এবং প্রকৃত ঘটনা তারা সঠিকভাবে দেশে-বিদেশে তুলে ধরতে পারেননি। এটাও এক ধরনের ব্যর্থতা।
আগামীতে আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে জোটকে আরও শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ১২ দলের নেতারা। এ জন্য জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে ‘একমঞ্চ’ গঠনের প্রস্তাব দেন কেউ কেউ। তাদের দাবি, এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আন্দোলন পরিচালিত হলে কর্মসূচি এবং শরিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পেত। তবে বৈঠকে এমন প্রস্তাবের বিরোধী মতও আসে। একজন নেতা বলেন, জামায়াতের নেতাকর্মীরা এমনিতেই নির্যাতিত-নিপীড়িত, সরকারের রোষানলের শিকার। তার ওপর আন্দোলনের একমঞ্চে উঠলে নির্যাতন-নিপীড়ন আরও বেড়ে যেতে পারে।
বৈঠকে আগামী মে থেকে প্রতীক ছাড়া অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন জোটের এক নেতা। তিনি বলেন, একের পর এক নির্বাচন বর্জন করলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় নির্বাচনের পর আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও না গেলে তৃণমূলে নেতাকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। তা ছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে না গেলেও নেতাকর্মীরা স্থানীয় নানাবিধ কারণে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারেন। তাই উপজেলার ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। এ সময় ১২ দলীয় জোটের অন্য নেতারাও তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন।
সূত্র মতে, সমাপনী বক্তব্যে শরিকদের হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, সব গুছিয়ে আন্দোলনকে আবারও তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে। একমঞ্চে আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠন বেশ দুরূহ। তা ছাড়া সরকারের অব্যাহত দমন-পীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতই একমঞ্চ চায়নি। সে কারণেই যুগপতের ধারায় আন্দোলন চলছে।
বৈঠকে ১২ দলীয় জোট নেতাদের মধ্যে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, আহসান হাবিব লিংকন, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাগপার রাশেদ প্রধান, জমিয়তের মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আব্দুল করিম, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠক প্রসঙ্গে কেউ উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
১২ দলীয় জোটের পর গুলশানের বাসায় গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মির্জা ফখরুল। এই বৈঠকে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডির তানিয়া রব, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুসহ ছয়জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, বৈঠকে মির্জা ফখরুল সর্বশেষ তার সাড়ে তিন মাসের কারাজীবনের নানা ঘটনা মঞ্চ নেতাদের অবহিত করেন।
বৈঠক প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তার আগে এটি মূলত তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল।