বরাবরের মতো এবারও জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) তৃণমূলের নানা সমস্যা তুলে ধরেছেন। ডিসি সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় সেসব সমস্যা সমাধানে নিজেদের ভাবনাও জানিয়েছেন তারা। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এসব সমস্যা সমাধানে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছে সহায়তা চেয়েছেন। তারা মনে করেন, মাঠ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সক্রিয়ভাবে কাজ না করলে সরকারের কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। সুতরাং মাঠ পর্যায়ে সরকারের ভাবমূর্তি ভালো করতে হলে এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।
গতকাল সোমবার ছিল জেলা প্রশাসক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। আগামীকাল বুধবার চার দিনের সম্মেলন শেষ হবে।
বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দেওয়া মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিসিরা মাঠ পর্যায়ের সমস্যার কথাই বেশি বলেছেন। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেহাল রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী অপ্রতুল ত্রাণ ও দুর্বল উদ্ধার কার্যক্রম, মাদক চোরাকারবারিদের উৎপাত ইত্যাদি বিষয় দিন দিন বড় সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ-মন্ত্রণালয়কে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব তুলেছেন ডিসিরা। তবে সরকারের দায়িত্বশীলরা এসব সমস্যা সমাধানে ডিসিদের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছেন। তারা মনে করছেন, মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারাই সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং মূল কাজ তাদেরই করতে হবে। সরকার শুধু সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারবে।
সূত্র জানায়, গতকাল ২৪ জন ডিসির ৮০টি প্রস্তাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সামনে অনেকটা খোলামেলা আলোচনা করেন ডিসিরা। এদিন বিভিন্ন অধিবেশনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়-বিভাগ নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রস্তাব ছিল সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিষয় সম্পর্কিত।
ডিসিদের খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলোতে দেখা গেছে, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে উপজেলা পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিস স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন ঢাকার ডিসি। প্রস্তাবের পক্ষে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত মনিটরিং, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। উপজেলা পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিস না থাকায় অনিরাপদ, ভেজাল ও দূষিত খাদ্য চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
উপজেলায় ত্রাণ গুদাম নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন ঢাকা ও মানিকগঞ্জের ডিসি। প্রস্তাবের পক্ষে তাদের যুক্তি, জরুরি দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ত্রাণসামগ্রী দ্রুত বিতরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে কোনো ত্রাণ গুদাম নেই। ত্রাণ গুদাম না থাকায় ত্রাণসামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণে মারাত্মক অসুবিধা হয়। সময়মতো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা সম্ভব হয় না। এজন্য ত্রাণ গুদাম নির্মাণ করতে হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ে সাইলো নির্মাণের প্রস্তাব করে সেখানকার ডিসি বলেছেন, জেলায় ধান, ভুট্টা, গম বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত হওয়ায় উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে কৃষকরা ফসল উৎপাদন করে সংরক্ষণ করতে পারছেন না। কৃষি পুনর্বাসনে সয়াবিন ফসল অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে বরিশালের ডিসি বলেন, বরিশাল জেলায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। সয়াবিন চাষিরা বর্তমানে কৃষি পুনর্বাসন সুবিধার আওতাভুক্ত নয়। তারা কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা পেলে সয়াবিন চাষ বৃদ্ধি এবং জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে ফলমূল ও শাকসবজিতে প্রচুর প্রিজারভেটিভ ও কীটনাশকের ব্যবহার সীমিতকরণের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করেছেন মাদারীপুরের ডিসি। তার যুক্তি বর্তমানে ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদন ও সংরক্ষণে ব্যাপকভাবে কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে। বিশুদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি থেকে দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এতে নানা প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
৫০ লাখ পরিবারে চাল:
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় পবিত্র রমজান উপলক্ষে আগামী ১০ মার্চের মধ্যে ৫০ লাখ পরিবারের কাছে দেড় লাখ টন চাল বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ১ মার্চ থেকেই লিফটিং (ডিলারদের চাল উঠাতে) করতে বলেছি। ১ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত আমাদের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। সেটা কমিয়ে ১০ মার্চের মধ্যে ৫০ লাখ পরিবারকে দেড় লাখ টন খাদ্য বিতরণ শেষ করা হবে। এতে বাজারে স্বস্তি ফিরবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেড় লাখ টন চাল যদি বাজারে ১৫ টাকা দরে যায়, তাহলে ৫০ লাখ পরিবারকে তো আর বাজার থেকে চাল কিনতে হবে না। এতে স্বস্তি আসবে বলে মনে করি।
জমি রক্ষায় ডিসিদের পাশে চান কৃষিমন্ত্রী:
অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা এবং ফসলি জমি রক্ষায় ডিসিদের সহযোগিতা চেয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে মজুতদারি রোধে তাদের সহযোগিতা চান মন্ত্রী। ব্রিফিংয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব পতিত জমিকে আবাদের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মধ্যে চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল, রেলপথের পতিত জমি চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনো অনাবাদি জমি আমরা খালি রাখতে চাই না। পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
বেদখল জমি উদ্ধারে সহযোগিতা চান রেলমন্ত্রী:
রেলের দখল হওয়া জমি উদ্ধার ও প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ডিসিদের সহযোগিতা চাইলেন রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম। মন্ত্রী বলেন, জনগণের কাছে প্রতিটি জেলায় রেল পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।
ডিসিরা কী সুপারিশ করেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবৈধ রেলক্রসিং যেখানে আছে, সেখানে আমরা সহায়তা চেয়েছি। যেহেতু আমাদের জনবল কম। বেদখল জমি উদ্ধারে তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। ডিসিরাও বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন।
প্লাস্টিকবিরোধী অভিযান জোরদারের আহ্বান পাটমন্ত্রীর:
পরিবেশ সুরক্ষায় প্লাস্টিকবিরোধী অভিযান জোরদার করার কথা জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ বাস্তবায়ন জোরদারকরণে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে কৃষকরা পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন, তা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করেছি।’