প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে প্রায়ই নারীর ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার থেকে গত চার মেয়াদে নারীর ক্ষমতায়নে যে চ্যালেঞ্জ, সীমাবদ্ধতা ও সফলতা ছিল, তাও বিস্তারিত বর্ণনা করেন। নারীর ক্ষমতায়নেই বাংলাদেশ তথা সমাজের উন্নয়ন সম্ভব, তার গুরুত্ব বোঝাতেই সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতা থেকে ‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ পঙক্তিটুকু উচ্চারণ করেন।
সরকারের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত সব পর্যায়ে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ধারাবাহিকতায় পঞ্চমবারের মতো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ও শিরীন শারমিন চৌধুরী তৃতীয়বারের মতো স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তেমনি সদ্য ঘোষিত মন্ত্রিসভায় ৭ জন নারী মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী রয়েছেনÑযা দেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নারীবান্ধব নীতি ও নারীর সুরক্ষার জন্য আইন তৈরি ও সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, সর্বোচ্চ আদালত, প্রশাসন, কূটনীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রদূত, বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চ পদ, সশস্ত্র বাহিনী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পেশায় দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। গ্রাম কিংবা শহরÑ সর্বত্র পুরুষের পাশাপাশি নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এখন নারীরা সমাদৃত ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি নারী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। বাংলাদেশের নারী এখন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসায় কর্মরত।
মুক্তিযুদ্ধের অসংবাদিত নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর অন্তরালের অনুঘটক ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। পারিবারিক এই আবহ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছেন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে নারীর ক্ষমতায়নে কাজ শুরুর মাধ্যমে সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটান শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু নারী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারি চাকরিতে ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করা, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্র স্থাপনসহ নানা কাজ শুরু করেছিলেন। নারী উন্নয়নের জন্য ঠিক সেই পথকেই অনুসরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে বিচারক, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নারীদের নিয়োগের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের যাত্রা শুরু করেন।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগে সরকার গঠন করে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে নারী ও সংসদ উপনেতা হিসেবে একজন নারীকে নির্বাচিত করেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী পদে নারীকে দায়িত্ব দেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রথম কোনো নারীকে নিয়োগ দেন। সংসদে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে সংরক্ষিত আসনে ৪৫ থেকে ৫০ আসনে বৃদ্ধির উদ্যোগ তিনিই নেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তার সরকারের আমলেই উপজেলা পরিষদে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি ও ইউনিয়ন পরিষদে তিনজন নারী সদস্য নির্বাচনের বিধান নিশ্চিত করা হয়।
নারীর উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। সেজন্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষার ব্যবস্থাও করেন শেখ হাসিনা। এর ফলে দেশে নারী শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত নারীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন করা, সন্তানের অভিভাবকের জায়গায় শুধু মায়ের নাম লেখার প্রচলনও চালু করেন শেখ হাসিনা। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ ২৯ শতাংশ, যা গত ১৫ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।
নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধা নিশ্চিত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সহিংসতা, নারী পাচার এবং অন্যান্য অপরাধ নিরসনের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে ২০২০ সালে।
এ ছাড়া পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, নারী উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৩, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭, যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮সহ নানান আইন করা হয় নারীদের জন্য। গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজধানীতে বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ৬ মাসে বর্ধিতকরণ এবং নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আলাদা ব্যাংকিং ও ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জয়িতা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য দেশব্যাপী একটি আলাদা নারীবান্ধব বিপণন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে।
নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে সরকার বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। মোট বাজেটের ৩৪.৩৭ শতাংশ এবং জিডিপির ৫.২৩ শতাংশ জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এ ছাড়া ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি), মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি, বাল্যবিবাহ রোধে কার্যকর উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে।
মূলত নারীবান্ধব এসব কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে উন্নয়ন হয়েছে বাংলাদেশের। শেখ হাসিনার নারীবান্ধব নীতির কারণে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষে। লিঙ্গ সমতা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের লিঙ্গ সমতার প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৯। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যে হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের ক্রমোন্নতি চোখে পড়ার মতো।
তাই বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের সাফল্যের মূল্যায়ন স্বরূপ শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের কারণে তিনি ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান উইমেন কর্তৃক ‘লাইফটাইম কন্ট্রিবিউশন ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, বাংলাদেশে নারী শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরিতে অসামান্য নেতৃত্বদানের জন্য ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য ‘উইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি)’ ও ইউনেস্কো ‘ডব্লিউআইপি গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড’, নারী শিক্ষার প্রসারে ‘ট্রি অব পিস’, নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ইউএন উইমেনের ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার ও ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ পুরস্কারে ভূষিত হন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের এমপি শাম্মী আহমেদ কালবেলাকে বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবক্ষেত্রেই কাজ করেছেন, যা এর আগে কেউ করেনি। কেউ কোনোদিন কল্পনাও করেনি যে নারীরা সচিব, বিচারক, পাইলট, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার হবে। তিনিই নারীদের সে সুযোগ করে দিয়েছেন। রাজনীতিতে নারীদের সুযোগ অবারিত করেছেন। তার উদ্যোগের কারণে শিক্ষায় নারীরা এখন এগিয়ে। আজকের বাংলাদেশে নারীরা যে সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছেছেন তার পুরোধা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।