দেশে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা। কয়েক বছর ধরেই দেশের মোট জনসংখ্যায় প্রতি হাজারে দুই থেকে তিনজন নতুন প্রতিবন্ধী যুক্ত হচ্ছে। নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতার হার বেশি। আর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ময়মনসিংহ বিভাগে তুলনামূলক বেশি প্রতিবন্ধী মানুষের বাস। প্রতিবন্ধিতার বড় কারণ অসুস্থতা। এ ছাড়া জন্ম ও বংশগত, দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, বার্ধক্য, ভুল চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কারণেও অনেকে প্রতিবন্ধী হন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’-এ এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএসের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২৮.২ জন, যা এক বছর আগে ছিল ২৫.৫ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে প্রতিবন্ধী বেড়েছে হাজারে প্রায় তিনজন। ২০২১ সালে হাজারে প্রতিবন্ধী ছিল ২৪.১ জন। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে হাজারে প্রতিবন্ধী বেড়েছে ৪ জনের বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশদূষণ, ভেজাল খাবার, ইলেকট্রনিক ডিভাইসের রেডিয়েশন প্রতিবন্ধিতা বৃদ্ধি করছে। নবজাতকদের কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়ার কারণেও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া অধিক মানসিক চাপে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রতিবন্ধিতা বাড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজ অর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বাড়ছে তথ্য ঠিকই আছে। প্রতিবন্ধিতার একটি বড় কারণ স্ট্রোক। মানুষের মধ্যে দিন দিন চাপ বাড়ছে। এ কারণে প্রেশার, হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ায় স্ট্রোক বাড়ছে। এ ছাড়া যত বেশি নগরায়ণ হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা তত বাড়ছে। এসব কারণে প্রতিবন্ধিতা বাড়ছে।’
গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতার মূল কারণ জন্মগত। বাচ্চা জন্মের সময় কোনো অসুবিধার কারণে এটার সারাজীবনের জন্য প্রতিবন্ধিতা ভোগে। তিনি বলেন, বাচ্চা জন্ম নেওয়ার সময় যেসব বাচ্চা অনেক ক্রিটিক্যাল অবস্থায় থাকে, সেসব বাচ্চা যখন বাঁচিয়ে ফেলা হয়, পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা দেখা দেয়। এটার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।’
জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারী বেশি হলেও পুরুষ প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রতি হাজারে ২৮.৬ পুরুষ প্রতিবন্ধী। ২০২২ সালে ছিল ২৬.৬ জন। ২০২১ সালে ছিল পুরুষ প্রতিবন্ধী ছিল ২৩.৮ জন। অর্থাৎ তিন বছরে দেশে পুরুষ প্রতিবন্ধী হাজারে বেড়েছে প্রায় ৫ জন। অন্যদিকে প্রতি হাজারে নারী প্রতিবন্ধী ২৭.৮ জন, যা ২০২২ সালে ছিল ২৫.৪ জন এবং ২০২১ সালে ছিল ২৪ .৪ জন। তিন বছরে নারী প্রতিবন্ধী বেড়েছে ৩.৪ জন।
শূন্য থেকে ৩৯ বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতার ব্যাপকতা অনেক বেশি। অন্যদিকে ৪০ থেকে ৬৫ তদূর্ধ্ব বছর বয়সভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ফল সম্পূর্ণ বিপরীত। এসব বয়সভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে প্রতিবন্ধিতার হার অনেক বেশি।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, শূন্য থেকে ৪ বছর বয়সে প্রতি হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে প্রতিবন্ধিতার হার সাতজন। এর পরের ধাপ ৫ থেকে ৯ বছর বয়সভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ হার হাজারে ১২.৮ জন। তবে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এ হার কমতে থাকে। এরপর ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে এ হার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং ৬৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে তা প্রতি হাজারের বিপরীতে ১৩৫.৪ জনে পৌঁছে যায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতার হার পল্লী অঞ্চলের মানুষের তুলনায় কম। শহরে প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২৩.২ জন, পল্লী অঞ্চলে এ হার ২৬.২ জন।
বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদন বলছে, সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী মানুষের বসবাস ময়মনসিংহ বিভাগে। এ বিভাগে প্রতি হাজারে প্রতিবন্ধী ৩০.৩ জন। এরপরের অবস্থানে থাকা রাজশাহী বিভাগে প্রতি হাজারে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২৮.৬ জন। চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগে গড়ে ২৬ জনের বেশি প্রতিবন্ধীর বসবাস। প্রতিবন্ধীর হারে সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। এ বিভাগে প্রতি হাজারে ২১.৩ জন প্রতিবন্ধী।
জরিপে চার ধরনের প্রতিবন্ধিতা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো প্রতিবন্ধিতার তীব্রতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলো হলো পরিপূর্ণ প্রতিবন্ধিতা, জটিল প্রতিবন্ধিতা, মোটামুটি প্রতিবন্ধিতা এবং হালকা বা আংশিক প্রতিবন্ধিতা। ধরন অনুযায়ী ১১.১ শতাংশ পরিপূর্ণ প্রতিবন্ধী, ১৮.৮ শতাংশ জটিল প্রতিবন্ধী, ৩০.৫ শতাংশ মোটামুটি প্রতিবন্ধী এবং আংশিক বা হালকা প্রতিবন্ধী ৩৬.২ শতাংশ।
জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবন্ধিতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জন্মগত, সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্যোগ-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা, অন্যান্য দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, বার্ধক্য, ভুল চিকিৎসা। প্রতিবন্ধিতার সবচেয়ে সুস্পষ্ট কারণ অসুস্থতার সঙ্গে যুক্ত বলে জরিপে চিহ্নিত হয়েছে। মোট ৩৩.৫ শতাংশ প্রতিবন্ধিতার জন্য অসুস্থতা দায়ী। এরপরের অবস্থানে রয়েছে বংশগত, বৈবাহিক এবং জন্মগত। এসব কারণ প্রতিবন্ধিতার হার ৩০.৬ শতাংশ।