বিশ্বজুড়ে এ পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হবে ২০২৪ সাল—জাতিসংঘ থেকে এ-সংক্রান্ত পূর্বাভাস দেওয়া ছিল অনেক আগেই। আরও হুঁশিয়ার করা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোই এর ক্ষতির মুখে পড়বে বেশি, যেখানে তার অন্যতম শিকার হবে বাংলাদেশ। বাস্তবেও সেটি এখন ঘটতে চলেছে। দেশের সর্বত্র সপ্তাহ দুয়েক ধরে মরুর উষ্ণতা বইছে। তীব্র রোদ আর খরতাপে ইটের মতোই জ্বলছে সব পথঘাট ও মাঠ। এত তীব্র তাপদাহ আগে কখনো অনুভূত হয়নি। এরই মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠেছে বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়া। একটু স্বস্তি পেতে মানুষ যখন জানালা খুলে গা এলিয়ে দিচ্ছে—সেখানেও খোঁচা দিচ্ছে বাতাসে মিশে থাকা আগুনের হলকা।
কারণ, দেশে ক্রমবর্ধমান জমির চাহিদার চাপে নিম্নভূমি ও জলাধারগুলো বালু-মাটি দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। এই বালু-মাটি তাপ আটকে রাখছে এবং সেটি ক্রমাগত তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এ কারণে আগের চেয়ে বেশি পানি বাষ্পীভূত হচ্ছে এবং শুষ্কতা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে তাপও বাড়ছে অব্যাহতভাবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে থমকে গেছে শহর-নগর ও গ্রামের জনজীবন। মানুষ নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। আবার যারা বের হচ্ছে, প্রচণ্ড গরমে-ঘামে ভিজে নেয়ে হচ্ছে একাকার। শুধু কি মানুষ? প্রাণিকুলের অবস্থাও নাকাল। গাছপালা-তৃণলতা ও ফল-ফসলের হাল বাস্তবে আরও করুণ। আবার স্থানভেদে এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের জনজীবন। বিশেষ করে ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে এসব এলাকার কোথাও কোথাও গভীর নলকূপেও পানি মিলছে না। ফলে সেচবিহীন অনেক ফসলি জমি ফেটে চৌচির অবস্থা। সব মিলিয়ে বিরামহীন এই তীব্র খরতাপ, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি, উৎপাদন ও অর্থনীতির হুমকি—কোনো কিছুই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। ফলে যার সরাসরি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে আগামীর অর্থনীতি তথা দেশের কৃষি খাত, প্রাণিজ সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতেও।
কৃষি উৎপাদনে প্রভাব: প্রলম্বিত তীব্র তাপদাহে ফল-ফসলের মাঠ পুড়ছে। হিট শকে মাঠের বোরো ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রামে বিদ্যুৎচালিত সেচ ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটছে। এ কারণে শেষ মুহূর্তে বোরো ধানের জমিতে পানি দেওয়া যাচ্ছে না। এতে ধানে অতিমাত্রায় চিটার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ মৌসুমি ফল মুকুলেই ঝরে পড়ছে। মাঠেই রোদের তাপে পুড়ে মরে যাচ্ছে ভুট্টা, কলাসহ নানা ধরনের ফসল। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র বলছে, এপ্রিলজুড়েই বইবে তাপপ্রবাহ। এ সময়ে বৃষ্টির সম্ভাবনাও তেমন নেই। ফলে ফল-ফসলের ক্ষতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) শীবেন্দ্র নারায়ণ গোপ জানিয়েছেন, তাপদাহের কারণে ফল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ-এ তিন জেলায় ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহ জাহান কবির বলেন, পানির অভাবে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনই দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে আশার খবর হচ্ছে, দিনে তাপমাত্রা বাড়লেও রাতে আবার তা কমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা কম।
এদিকে উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশেই এখন তীব্র খরতাপ অনুভূত হচ্ছে। বর্তমানে খরার তীব্রতা আগের দুই দশকের তুলনায় ২৯ শতাংশহারে বাড়ছে। তবে একসময় খরার ঝুঁকি উত্তরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০২২ সালের সামগ্রিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সারা দেশকে খরার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে উপকূলীয় অধিবাসীদের। নলকূপ এমনকি গভীর নলকূপেও অনেক স্থানে পানি উঠছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে খাবার পানিসহ সেচের পানির অভাব প্রকট রূপ নিয়েছে। এই যখন অবস্থা, তখন প্রচণ্ড তাপদাহের এই সময় লোডশেডিং ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং কোথাও কোথাও ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে সেচ ব্যাহত হচ্ছে। এতে সার্বিক কৃষি উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি আড়াই বছরে একবার বড় ধরনের খরায় আক্রান্ত হয়। এ বছর দেশে তার প্রভাব রয়েছে। তীব্র খরতাপের কারণে নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলাসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলজুড়ে এখন খরা চলছে। খরাপ্রবণ এসব জেলায় মোট জমির পরিমাণ হচ্ছে ৫৪ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর, যা প্রায় দেশের মোট আবাদি জমির ৭৭ শতাংশ। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, খরার কারণে প্রতিবছর এই অঞ্চলে ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। ৯০ দশকে খরার কারণে দেশে ৩৫ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কম হয়।
মৎস্য চাষে বিপুল ক্ষতি: সারা দেশেই কমবেশি মৎস্য চাষ হয়। তবে ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোরসহ দেশের ২৭টি জেলায় মাছ চাষ হয় বেশি। মাছ চাষের বেশিরভাগ উৎসই হলো অগভীর পুকুর। কিন্তু প্রখর রোদ এবং অতিমাত্রার তাপ এসব অগভীর পুকুরের পানি দিনের বেলায় বেশ গরম হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় চাষ করা মাছের জীবনধারণ চক্র কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে অনেক জেলায় চাষ করা মাছের আংশিক মরে যাওয়ার খবর দিচ্ছেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা। বিশেষ করে তীব্র গরমের কারণে এখন সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হচ্ছে রেণু পোনার উৎপাদনে। গত দুই সপ্তাহ ধরে রেনু পোনার উৎপাদন এখন আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আবার এতে খরচও বেড়েছে। যার প্রভাব পড়বে আগামী মাসগুলোয় দেশে মাছ সরবরাহে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভাব: দেশের সর্বত্র এখন সপ্তাহ দুয়েক ধরে মরুর উষ্ণতা বইছে। তীব্র রোদ আর খরতাপে ইটের মতোই জ্বলছে সব পথঘাট ও মাঠ। এত তীব্র তাপদাহ আগে কখনো অনুভূত হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে থমকে গেছে শহর-নগর ও গ্রামের জনজীবন। এতে মানুষ নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। এতে করে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর। কারণ, তীব্র গরমের প্রভাবে সরকার এরই মধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও অনলাইনে নেওয়ার কথা জানিয়েছে। এতে করে রাজধানীসহ সারা দেশে রাস্তাঘাটে মানুষের যাতায়াত এখন অর্ধেকে নেমেছে। ফলে সড়কে চলাচলরত গণপরিবহণগুলোর সিট বেশিরভাগই ফাঁকা থাকছে। আগে যেখানে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েও স্টপেজ থেকে বাসে ওঠা দায় হয়ে যেত, এখন যেখানে-সেখানে বাস থামিয়েও প্যাসেঞ্জার মিলছে না। একই অবস্থা রেল ও নৌপথেও। সব মিলে তীব্র গরম এখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় টাকার প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব: রাস্তাঘাটে মানুষের যাতায়াত কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও। ক্রেতার অভাবে মার্কেট ও বিপণিবিতানও খোলা হচ্ছে দেরিতে। আগে অনেক দোকান ১০টার মধ্যেই বেচাকেনা শুরু হতো। এখন সকাল ১১টায় দেখা যায় অনেক দোকানের শাটার খুলতে। আবার যারা আগে থেকেই খোলা রাখছেন, সেখানে মিলছে না ক্রেতা। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে লোকজন মার্কেটে যাচ্ছে না। ফলে দিনভর খোলা রেখেও বেচাকেনাও হচ্ছে কম।
কমে গেছে দিনমজুরের আয়: দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মজীবীই হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। এদের অধিকাংশই আবার সকর্মে নিয়োজিত। কেউ চালায় রিকশা, কেউ ঠেলাগাড়ি, স্কুটার-সিএনজি বা অন্য কোনো যানবাহন। তীব্র গরম আর খরতাপে উত্তপ্ত রাস্তায় নিজেদের বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারছেন না তারা। ফলে রিকশা বা ঠেলাগাড়িওয়ালা যারা রয়েছেন, তারা কোনোমতে একটি খ্যাপ মারার পর দীর্ঘক্ষণ থাকছেন বিশ্রামে। ফলে আয়ের বড় একটা সময় তাদের নষ্ট হচ্ছে। অনেকে আবার দিনের বেলায় বেরোচ্ছেন না। দিনভর বিশ্রাম নিয়ে বেলা গড়িয়ে বিকেল হলে তারা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামছেন। এতে যেটুকু আয় হচ্ছে, তা দিয়েই দিনযাপনের চেষ্টা করছেন।
স্বাস্থ্য খাতে বাড়ছে ব্যয়: একটার সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক ওতপ্রোত। তাপদাহ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। হিটস্ট্রোকে এরই মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধরাই এর শিকার হতে পারে বেশি। চিকিৎসাবিদরা এ অবস্থায় কী করতে হবে, কী করতে হবে না—সেই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে স্বাস্থ্যের প্রতি মানুষকে বাড়তি যত্নশীল হতে হচ্ছে। বেশি করে জুস, স্যালাইন কিংবা ফলমূল খেতে হচ্ছে। এর বাইরে এরই মধ্যে সারা দেশে গরমজনিত ফুড পয়জনিং বা ডায়রিয়ার হার অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। অন্যান্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে গরমে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন, তাদের পকেটে নির্ধারিত আয়ের চেয়ে বাড়তি খরচ হচ্ছে।