বৈশ্বিক উন্নয়ন, ক্রমাগত শিল্পায়ন ও জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণ বাড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ওজোন স্তর হ্রাস, বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়ের কারণে সৃষ্ট দূষণ আর তীব্র তাপদাহের কারণে মানুষের মধ্যে কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বায়ুদূষণে অ্যাজমা, নিউমোনিয়ার মতো রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তা ছাড়া মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা, গর্ভপাত, জন্মত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশেও বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বায়ুদূষণ। ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে প্রদাহ, নিউমোনিয়াসহ ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। এ ছাড়া কার্ডিওভাস্কুলার স্বাস্থ্যের সমস্যা, ক্যান্সার এবং অকাল মৃত্যু বেড়েছে। গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরুতেই হাসপাতালের শয্যা, মেঝে ছাড়িয়ে বারান্দায়ও রোগীকে জায়গা দিতে হচ্ছে।
বিপজ্জনক ও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে ঘটে পরিবেশ দূষণ। এ ধরনের দূষণ বেশিরভাগ শিল্প কার্যক্রম, কৃষি রাসায়নিক ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য নিষ্পত্তির কারণে হয়। দূষণের পেছনে দায়ী রাসায়নিক হলোÑ পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বন, দ্রাবক, কীটনাশক, সীসা, পারদ ও অন্যান্য ভারী ধাতু। এসব রাসায়নিক মানব স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে মাথাব্যথা, চোখের জ্বালা ও ত্বকে ফুসকুড়ি থেকে শুরু করে আরও অনেক গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। মাটিতে উচ্চমাত্রার সীসা শিশুদের মস্তিষ্কের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অন্যদিকে পারদের সংস্পর্শে অঙ্গের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়াতে পারে, এমনকি কিডনি ও লিভারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পানির দূষণ ঘটে মূলত রাসায়নিকের কারণে। বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য পদার্থ পানিতে নির্গত হয়। এতে হেপাটাইটিস, এনসেফালাইটিস, গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস, ডায়রিয়া, বমি, পেট ব্যথার মতো গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি প্রজনন সমস্যা ও স্নায়বিক ব্যাধিরও কারণ হতে পারে এই পানিদূষণ।
সারা ইসলাম (১০) নামে বাড্ডার এক শিশুকে নিয়ে গত সোমবার শ্যামলী বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) এসেছেন মা লুবনা জাহান লুনা। স্বামী পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি গৃহিণী। তিনি জানান, গতকাল (রোববার) রাত থেকে সারা তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছে। নেবুলাইজ করার পরও শ্বাসকষ্ট কমেনি। তাই তিনি সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। সারা এরই মধ্যে দুইবার নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়েছে। এর জন্য চিকিৎসকরা বায়ুদূষণকে দায়ী করেছেন বলে তিনি জানান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে রাজধানীতে তারা হাঁপিয়ে উঠেছেন। কখনো মেয়ে অসুস্থ আবার কখনো ৪ বছরের ছেলে আরিস ও সারা দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তারা কয়েকবার রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীর চাকরির জন্য যেতে পারেননি। বাধ্য হয়েই নগরীতে থাকছেন। আক্ষেপ করে বলেন, রাজধানী এখন আর বাসযোগ্য নেই। কিন্তু জীবিকার তাগিদে এসব জেনেও থাকতে হচ্ছে। রোগবালাইও বাড়ছে। নিরুপায় সবাই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণও পরিবেশ বিপর্যয়ে একাধিক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। ফলে কমছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণের কারণে দরিদ্র নারী, শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ, তারা বেশিরভাগই দূষিত এলাকায় বসবাস করেন। ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ ও স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বাদের শারীরিক ক্ষতির অন্যতম কারণ হলো বায়ুদূষণ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে অন্তঃসত্ত্বাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুসারে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমেছে সাত বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে আট বছর করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ুদূষণজনিত। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতি হতে পারে। একই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন—ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমাসহ নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক জরিপে দেখা যায়, প্রজনন স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে বায়ুদূষণ। বিশেষজ্ঞদের মতে বায়ুদূষণে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে। এমনকি শুক্রাণুর মানও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে নারীদের ডিম্বাণু কল্পনাতীতভাবে কমে গেছে। আবার যেসব ডিম্বাণু আছে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্যান্সার ও হৃদরোগের জন্যও দায়ী বায়ুদূষণ। দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার ও হৃদরোগ হতে পারে। এমনকি সেটি মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
ক্যাপসের অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকায় চলাচল করা ১৬ লাখ গাড়ির এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ পাঁচ লাখের বেশি গাড়ি দূষণের জন্য দায়ী। জীর্ণশীর্ণ গাড়িগুলো চলতে দেওয়ায় দূষণ বাড়ছে। কোন উৎস থেকে কতটুকু দূষণ হচ্ছে তা-ও জানা আছে সরকারের। উৎসগুলো থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে টেকসই ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারায় দূষণ নির্মূল হচ্ছে না। মাতুয়াইল, আমিনবাজার ময়লার ভাগাড়সহ ঢাকার অন্তত ১০০ স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হয়। ঢাকার আশপাশে ইটভাটায় সয়লাব। শহর থেকে গাছ হারিয়ে গেছে। নদনদী, খাল ও জলাধার ভরাট হয়েছে। এসব কারণে দেশের বায়ুমান খুব নিম্নমানের। অন্যদিকে যোগ হয়েছে তাবদাহ। এসব মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নয়তো জনস্বাস্থ্যে আরও বিরূপ প্রভাব পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, বাসযোগ্য নগরীর সব সূচকে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না হলে টেকসই উন্নয়ন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। বৃক্ষ নিধন, জ্বালানি তেলের মান বৃদ্ধি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও কালো ধোঁয়া, যত্রতত্র বর্জ্যের ছড়াছড়ি। ঢাকার চারপাশের ইটভাটা, জলাধার, খাল ভরাট—এসব এখনই রোধ করতে হবে। এসব খাতে মনোযোগ নেই বলেই বায়ুর মান দূষণের শীর্ষে। রোগাক্রান্ত হচ্ছে জাতি।
জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, সবকিছু সরকার বা রাষ্ট্রের আশায় থাকলে ঢাকা বাসযোগ্য নগরী হয়ে উঠবে না। নিজেদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। পাড়া মহল্লার ফাঁকা জায়গায় পর্যাপ্ত গাছ লাগাতে হবে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির ধোঁয়ার বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।