অবশেষে অবসান ঘটল দীর্ঘ অপেক্ষার। মায়ের বুকে ফিরেছেন ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমদ; দুই মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা ও উনাইজা মেহবিন ফিরে পেয়েছে প্রধান কর্মকর্তা বাবা আতিক উল্লাহ খানকে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় এমভি জাহান মণি-৩ লাইটার জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-১ (এনসিটি) নম্বরে ২৩ নাবিক নামলে সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের। সবার চোখে পানি, মুখে হাসি। তাদের বরণ করতে আসা পরিবারের সদস্যরা অনেকে নিয়ে আসেন পছন্দের খাবার। নাবিকদের চট্টগ্রাম বন্দরে দেওয়া হয় বীরোচিত সংবর্ধনা। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-১ (এনসিটি) জেটিতে পৌঁছে জাহাজ থেকে একে একে নেমে আসেন নাবিকরা। এনসিটি জেটিতে আগে থেকে অপেক্ষায় ছিলেন নাবিকদের অনেক স্বজন, জাহাজের মালিক পক্ষসহ বন্দরের কর্মকর্তারা। জেটিতে নাবিকরা নামার পর স্বজনরা তাদের জড়িয়ে ধরেন। এ সময় কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। বন্দরের এনসিটি এলাকায় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুহূর্তে যেন নিস্তব্ধতা নেমে আসে কর্মচঞ্চল জেটিতে।
এদিকে এনসিটি-১ নম্বর জেটিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নাবিকদের জন্য এক সংবর্ধনার আয়োজন করে। সেখানে তাদের লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কেএসআরএমের পক্ষ থেকে নাবিকদের বরণ করা হয়।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। উপস্থিত হন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও বন্দরের সচিব ওমর ফারুক।
কেএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘এই একটা ঘটনার সঙ্গে শুধু ২৩ নাবিকই নন, অনেক মানুষের জীবন জড়িত। আমরা অনেক উৎকণ্ঠায় ছিলাম। কিন্তু আশা ও সাহস হারাইনি। অবশেষে আমাদের ভাইয়েরা আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন। এটাই অনেক বড় পাওয়া। আমাদের নাবিকেরা তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সবাই আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছেন। আর আমরা জাহান মণির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। যদিও নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার কাজটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ও অনিশ্চয়তায় ভরা।’
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। নাবিকরা তাদের স্বজনদের কাছে ফিরে এসেছে। সবাই খুব খুশি।’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমি আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত, পুলকিত।’
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ২৩ নাবিকের আসার দিনক্ষণ আগে থেকেই জানা ছিল স্বজনদের। এমভি আব্দুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খানের দুই মেয়ে ইয়াশরা ও উনাইজা স্বজনদের সঙ্গে জেটি চত্বরে চলে আসে। জীবনের রঙিন দিনটিকে স্মরণীয় করতে রঙিন ফুল নিয়ে এসেছিল তারা। তা দিয়ে বাবাকে বরণ করে নেয় দুই কন্যা। জাহাজ থেকে নামতেই দুই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেন আতিক উল্লাহ খান। আর বাবার গালে-মুখে আদরের চিহ্ন এঁকে দেন চুমুর মাধ্যমে। এমন দৃশ্যে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন উপস্থিত অনেকেই। এই আনন্দ প্রকাশের ভাষা যেন ছিল না আতিক উল্লাহ খানের। শুধু বললেন, ‘এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম।’
আতিক উল্লাহ খানের দুই শিশুসন্তানের মতো উচ্ছ্বাস ছিল জ্যোৎস্না বেগমেরও। ছেলে তানভীর আহমেদ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী। জিম্মি হওয়ার চিন্তায় চিন্তায় অস্থির ও অসুস্থ হওয়ার অবস্থা। এখন ছেলেকে পাওয়ার পর এই মায়ের খুশি আর দেখে কে! ছেলেকে বহনকারী জাহাজ জেটিতে পৌঁছার আগে জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘এত আনন্দ আগে কখনো পাইনি। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ৩৩ দিন যে কীভাবে কেটেছে, তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। এখন ছেলেকে কাছে পাব, এর চেয়ে বড় সুখ কী হতে পারে।’
মায়ের বুকে ফিরতে পেরে ছেলে তানভীরও ছিলেন উচ্ছ্বসিত। তানভীর আহমদ বলেন, ‘জিম্মিদশায় থাকা অবস্থায় ৩৩ দিন মনে হচ্ছিল বছরের বেশি। কবে ফিরব বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আরও দীর্ঘ হবে। আজকের এ মুহূর্তের জন্যই সারাক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম।’
বন্দরে পৌঁছে জাহাজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ বলেন, সোমালিয়ার দস্যুদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আজ আমরা এখানে পৌঁছাতে পেরেছি। আমরা ২৩ নাবিকই পৌঁছাতে পেরেছি। আমাদের সরকার কৌশলগতভাবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি বলেছিলাম বিদেশি নৌবাহিনী যেন ভায়োলেন্স না করে, যাতে আমাদের নাবিকদের কারও প্রাণ না যায় বা জাহাজের কোনো ক্ষতি যেন না হয়। আমি আমাদের নৌবাহিনীপ্রধানকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা সবাই সুস্থ ও অক্ষতভাবে পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি। এ এমন অনুভূতি—যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এক প্রশ্নের জবাবে ক্যাপ্টেন বলেন, প্রথম দিন যখন আমরা দস্যুদের হাতে আক্রান্ত হলাম, তখন সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিলেন। আমি নিচে নেমে অ্যালার্ট দিচ্ছিলাম। সবকিছু অতি দ্রুত ঘটছে। দস্যুরা স্পিডবোটে এসে জাহাজে উঠে ব্রিজে চলে আসে। আমি আর সেকেন্ড অফিসার আমাদের হিডেন রুমে যেতে পারিনি। সেকেন্ড অফিসার আটক হওয়ার পর আমি গিয়ে দেখি একে-৪৭ তাক করে আছে তার দিকে। আমি যেতেই আমার দিকেও একে-৪৭ তাক করে। আমি হাত তুলে সারেন্ডার করে বললাম, ‘আমরা বাংলাদেশি, আমরা মুসলিম। আমরা রোজা আছি।’
এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের ডেক ক্যাডেট সাব্বির। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে মৃত্যু আতঙ্কে। কখন কী হয়, পরিবারের সদস্যদের আর দেখতে পাব কি না, তা নিয়েই ভাবতাম জিম্মি থাকাকালীন প্রতিটি সময়। যখন মুক্তির খবর পাই, তখন মনে শান্তি আসে।
সোমবার সন্ধ্যার আগে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় নোঙর করে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। এখান থেকেই দুবাইয়ের হারমিয়া বন্দর থেকে আনা চুনামাটি লাইটারেজ জাহাজে খালাসের পর চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটে নিয়ে আসা হয়েছে নাবিকদের। সোমবার রাতেই জাহাজের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন নতুন ২৩ নাবিক। এর আগে শনিবার দুপুরে এমভি আব্দুল্লাহ বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে।
এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। এমভি আবদুল্লাহ গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। এর মধ্যে ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে জাহাজটি। প্রায় এক মাস পর গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজসহ ২৩ নাবিক মুক্তি পান।