জাতীয় নির্বাচনের প্রায় পাঁচ মাস পর সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। নতুন নির্বাচনের দাবির পাশাপাশি আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা, ডলার সংকট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মতো জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানা ইস্যুতে রাজপথে সোচ্চার হতে চায় দলটি। যুগপতের কাঠামো ধরে রেখেই ঈদুল আজহার পর ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা রয়েছে। গত ১২ থেকে ১৬ মে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে যুগপতের শরিকদের কাছ থেকে প্রস্তাব ও মতামত নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বিবেচনায় রেখে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এখন আন্দোলনের রূপরেখা ও কর্মসূচি চূড়ান্ত করছেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও যুগপতের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি শুরুর লক্ষ্যে শরিকদের সঙ্গে এরই মধ্যে একদফা বৈঠক হয়েছে। এর বাইরেও আলোচনা হচ্ছে। তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আরও আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন দলীয় কর্মসূচির মধ্যে রয়েছি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন করছি। আশা করছি, ঈদুল আজহার পর যুগপতের কর্মসূচি শুরু হবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপির সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের একটি অংশ আগামীর আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীসহ সব মতের রাজনৈতিক দলগুলোকে একমঞ্চে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছে। সেটা সম্ভব না হলেও যুগপৎ আন্দোলনের পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ তাদের। তবে জামায়াতের বিষয়ে কোনো কোনো দল বা জোট তাদের আপত্তি জানিয়েছে। আলোচনায় বিএনপি শরিকদের কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ কিংবা নাকচ করেনি। তবে এ মুহূর্তে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে যেসব দল ও জোট যুগপতে যুক্ত হয়েছিল, তাদের নিয়েই নতুন করে মাঠে নামতে আগ্রহী। কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় যুগপতের আওতা সম্প্রসারণের বিষয়টি বিবেচনা করতে চায় বিএনপি। ফলে এখনই আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ‘একমঞ্চ’ গঠনের সম্ভাবনা নেই।
এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগপতের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য মো. শাহজাহান কালবেলাকে বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা আগামীতে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও মতের লোকদের নিয়ে আন্দোলন করতে চাই। তবে তাদের একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যুগপতে আনতে হবে। এখন যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের কাজ চলছে। আশা করছি, শিগগিরই আন্দোলন মাঠে গড়াবে। তারপর যুগপতের পরিধি বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। সময় এবং পরিবেশ-পরিস্থিতিই বলে দেবে, কখন কারা সেখানে যুক্ত হবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন পুনর্গঠনের জন্য শরিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। আশা করছি, দ্রুতই সেই আলোচনা সম্পন্ন করতে পারব এবং ঈদের পর যুগপতের কর্মসূচি নিয়ে দেশবাসীর সামনে হাজির হতে পারব। তার আগে বিএনপির সঙ্গে হয়তো গণতন্ত্র মঞ্চের আরও এক-দুই দফা বৈঠক হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুগপতের শরিক যে দলগুলো আছে তারা আগামীতে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে মাঠে অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন; যুগপৎকে কীভাবে আরও জোরদার, সংহত ও গতিশীল করা যায়; এমনকি যুগপতের বাইরেও যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তারাও যাতে আগামীতে রাজপথে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে—সে ব্যাপারেও আমাদের একটা আহ্বান থাকছে। বাস্তবে দেশের যে পরিস্থিতি তাতে সব বিরোধী দলকে নিয়ে রাজপথে একটা কার্যকর ঐক্য গড়ে তোলা এখন দরকার।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে প্রধান শরিক বিএনপির সঙ্গে এরই মধ্যে সমমনা জোটের বৈঠক হয়েছে। এখন কর্মসূচি প্রণয়নের কাজ চলছে। আশা করছি, ঈদের পর পুনরায় যুগপৎ আন্দোলন শুরু হবে।’
এর আগে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও বর্তমান সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। সেবার দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ভোট করে দলটি। নির্বাচনের আগে বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য মিলে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। এরপর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সেখানে যোগ দেয়। একদিকে ২০ দল, অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট—দুই জোট সামলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে নেমেছিল বিএনপি। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ‘ব্যাপক’ গুরুত্ব দেওয়া এবং ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন করায় চরম অসন্তুষ্ট ছিল ২০ দলীয় জোটের শরিকরা। সেই নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটে। অবশ্য সেজন্য ভোটে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপিকে দায়ী করে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তাদের অভিযোগ ছিল, ‘প্রশাসনের সহায়তায় আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়।’
ওই নির্বাচনের ফলও প্রত্যাখ্যান করেছিল তারা। তবে নানা নাটকীয়তার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাদে ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেন। এ নিয়ে জোটের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। শুরুতেই ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
আর পরস্পরের ত্রুটি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দুই জোটের নেতারা। বিশেষ করে কামাল হোসেনকে নেতা মেনে ভোটে যাওয়াকে বিএনপির জন্য চরম ভুল ছিল বলে ২০ দলীয় জোটের মূল্যায়ন ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বৈঠক কমতে থাকে, থেমে যায় কর্মসূচিও। তবে কৌশলগত কারণে কোনো জোটকেই নাকচ করেনি বিএনপি। মাঠের কর্মসূচি না থাকায় একপর্যায়ে দুটি জোটই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ওই পরিস্থিতিতে সংগঠন পুনর্গঠন করে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে বিএনপি। এরই একপর্যায়ে অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় জোটবদ্ধ আন্দোলনের পরিবর্তে যুগপতের পথে হাঁটে দলটি। জামায়াতনির্ভরতা কাটানো এবং রাজনীতিতে ‘বিএনপি-জামায়াত’ যুথবদ্ধ নামের নেতিবাচক প্রচারণা কাটানোও ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য।
২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। তার আগের দিন শরিকদের নিয়ে এক অনানুষ্ঠানিক সভায় ২০ দলীয় জোট বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
দশ দফা দাবিতে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। বিলুপ্ত ২০ দলীয় জোটের বাকি শরিকরা আলাদাভাবে ‘১২ দলীয় জোট’ ও ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’-এ যুক্ত হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুই শরিকসহ সাতটি দল নিয়ে গঠিত হয় গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ছাড়া বাম ঘরানার চার দলের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’ যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। জামায়াত প্রথম দুটি কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালন করে। তবে পরবর্তী সময়ে যুগপতের বাইরে নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল দলটি। অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি যুগপৎ আন্দোলনে এককভাবে কর্মসূচি পালন করে। দশ দফা দাবিতে শুরু হলেও একপর্যায়ে যুগপৎ আন্দোলনে সরকার পতনের ‘একদফা’ সামনে আনা হয়। সব মিলিয়ে ছোট-বড় ৪০টি দল এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল। দলগুলো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে।
এদিকে যুগপতের বাইরে থাকলেও ছয়টি বামপন্থি দলের ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’, ইসলামপন্থি ছয় দলের ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’ এবং চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে ছিল। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এসব দল ও জোটকে যুগপতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। যুগপতের একাংশের বিরোধিতায় সফল হয়নি জামায়াতকে নিয়ে ‘একমঞ্চ’ গঠনের উদ্যোগও।
বিএনপি ও তাদের মিত্রদের আন্দোলন ও ভোট বর্জনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। অবশ্য ১২ দলীয় জোটভুক্ত নিবন্ধিত দুটি দল যুগপৎ আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে। তবে বিএনপি ও শরিকদের দাবি, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট বর্জন করেছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের ‘নৈতিক বিজয়’ হয়েছে।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সেই ভোট বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তবে রাজপথে কর্মসূচি না থাকায় সেই আন্দোলনে ছন্দপতন ঘটে। নির্বাচনের প্রায় পাঁচ মাস পরও মাঠে গড়ায়নি যুগপতের কর্মসূচি। অবশ্য এ সময় বিএনপিসহ যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলো নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে। আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে তারা সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে। একই সঙ্গে বিগত আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট ‘হতাশা’ কাটাতে এবং তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে কারামুক্ত নেতাদের সংবর্ধনাসহ নানা উদ্যোগও নিয়েছে বিএনপি।