দীর্ঘদিন ধরেই সংকটে দেশের অর্থনীতি। মানদণ্ড নির্ধারক প্রায় সব সূচকই এতে নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। সরকারের হাতে অর্থ কম। প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় আসছে না। ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ঋণ করতে হচ্ছে। এই সময়ে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার সরবরাহে ঘাটতি ও দাম বৃদ্ধির প্রবণতা। যার ধাক্কা লেগেছে আমদানি ব্যয়ে। এতে চলতি অর্থবছরে দুই দফায় টাকার অবমূল্যায়ন ঘটাতে হয়েছে। এখন কম পণ্য ও সেবা কিনতেই ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে বেশি। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধে ব্যয় আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। এসবের সার্বিক প্রভাবে রিজার্ভ নেমেছে তলানিতে। আর মূল্যস্ফীতির পারদ আরও ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। এতে একদিকে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে ব্যয়ের তুলনায় মজুরি মূল্য না বাড়ায় বড় ধরনের অস্বস্তিতে পড়েছে সার্বিক জনজীবন।
অর্থনীতির এই দুষ্টচক্র সামাল দেওয়ার চেষ্টায় যখন আরও একটি বছর অতিক্রম হওয়ার দ্বারপ্রান্তে—ঠিক সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এই সংকটময় পরিস্থিতি উত্তরণ ঘটানোর দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রাখতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাজেটের প্রবৃদ্ধিতে গত প্রায় দেড় দশকের ঐতিহ্য ভেঙে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা পরিহার করে প্রথমবারের মতো মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় বাজেটের আকার সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি ঘটাতে চলেছেন। একই সঙ্গে বাজেটে আয়-ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতি রাখছেন মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
অর্থাৎ সংকটকালে সংকট মোচনে তিনি ব্যয়কে যতটা সম্ভব সংকোচনমুখী রাখতে চান তার বাজেট পরিকল্পনায়। একই সঙ্গে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’ও রাখবেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনার বাজেট প্রস্তাব করবেন। যেখানে এই বাজেট বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা, রিজার্ভ উন্নয়ন, ডলারের দামে অস্থিতিশীলতা, কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, সুদ পরিশোধে বাড়তি খরচের জোগান এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারে বকেয়া ভর্তুকি ব্যয়ের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বৃদ্ধিজনিত ব্যয় সামলানোকে।
তবে এই চ্যালেঞ্জকে অর্থমন্ত্রী মোকাবিলা করতে চান দক্ষ ও কৌশলী বাজেট ব্যবস্থাপনা দিয়ে। এজন্য তিনি সংকোচনমুখী বাজেট তৈরিতে মনোযোগী হলেও একই সঙ্গে অর্জন করতে চান রাজস্ব আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্য। সেজন্য তিনি কিছু ক্ষেত্রে করহার বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণের কাছে অত্যাবশ্যকীয় বেশ কিছু পণ্যে রাখবেন কর ছাড়ের সুবিধা। অন্যদিকে নীতি পদক্ষেপের ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা সম্প্রসারণ, উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে ভর্তুকি বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কথা বলবেন। যেখানে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান তৈরিতেও থাকবে নজর।
যদিও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি এতটাই নাজুক, যেখানে দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব প্রশাসনে বড় রকমের সংস্কারের পাশাপাশি সরকারি খরচের ব্যাপারে আরও সাশ্রয়ী, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে ব্যয় সংকোচনমুখী বাজেটের এই লক্ষ্য অর্জনও কঠিন হবে।
অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জন্য যে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনা সাজিয়েছেন, সেখানেও তিনি ব্যয় করতে চান বেশি এবং আয়ের লক্ষ্য ধরেছেন কম। এজন্য বাজেটে অনুদান ব্যতীত ঘাটতি রাখতে যাচ্ছেন ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
বাজেটে আয়ের মোট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি কর থেকে আয় করতে চান ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। যেখানে করসমূহের আয় হবে ৪ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আয় আসবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আয় আসবে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া প্রাপ্তি আসবে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
এবারের বাজেটে সরকারের মোট পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। পরিচালন খাতের আবর্তক ব্যয়ের আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সুদ পরিশোধেই ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যেখানে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৯৩ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে যাবে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি অর্থের মধ্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে ব্যয় হবে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা, বেতনভাতায় ৮৭ হাজার কোটি এবং মূলধনি ব্যয়ে যাবে ৩৭ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।
ঘাটতি অর্থায়নের উৎস হিসেবে আসবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যেখানে নিট ঋণের পরিমাণ ধরা হয় ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। যেখানে ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ঋণের জোগান আসবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৮ হাজার কোটি টাকা।
উন্নয়ন ব্যয়ের পরিকল্পনায় সরকার ব্যয়ের যে আকার নির্ধারণ করেছে, সেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয় হবে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৬ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় এডিপিবহির্ভূত উন্নয়ন অংশের জন্য। এতে সরকারের বিভিন্ন স্কিম পরিচালনায় ব্যয় রাখা হয়েছে ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। বিশেষ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৭ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের যে সংকোচনমুখী আকার ধরা হচ্ছে, সেটি সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বাস্তবে এই কম লক্ষ্যমাত্রাই কতটা অর্জন হবে, সেটি নিয়ে সংশয় তো রয়েছেই। তবে এই বাজেটে যেহেতু সরকারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই মূল ফোকাস হচ্ছে, সেখানে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আপস তো করতেই হবে। একই সঙ্গে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে, সেটি নিয়ে সংশয় থাকলেও যদি সংস্কারের মাধ্যমে একটি আধুনিক কর প্রশাসন তৈরি করতে পারে তাহলে লক্ষ্যের অনেকটাই কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, এ সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাতের সংস্কার। এ খাতের সংস্কারে ব্যর্থতা শুধু বেসরকারি খাতই নয়, সরকারের বাজেট বাস্তবায়নেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ব্যাংক খাত বাজেটকে প্রতিফলিত করে। কারণ এটি সরকারি ঋণ ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের সুদ, সেইসঙ্গে রাজস্ব আহরণকে প্রভাবিত করে। তা ছাড়া আগামী বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে সরকার যে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে, সেটিও যৌক্তিক নয়। কারণ, বর্তমানে এ খাতে তারল্য সংকট চলছে। এ অবস্থায় ব্যাংক খাত থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হলে বেসরকারি খাতে অর্থায়নে সংকট দেখা দিতে পারে।