জ্যেষ্ঠ আটজনকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি পেয়ে আলোচনায় এসেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। এরপর বাগিয়ে নেন সংস্থাটির অধীনে থাকা কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক পদ। দায়িত্ব নিয়েই একের পর এক অনিয়মে জড়িয়েছেন এই কর্মকর্তা। বিএডিসির নিজস্ব আয়ের টাকা অন্য হিসাবে রাখা, নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কমিশনের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করে বিএডিসি। তবে মেয়াদ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে মিজানুরের দায়িত্বে থাকা প্রকল্প নিরীক্ষা করে নানা বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) আওতাধীন কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তর।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএডিসির আইন অনুযায়ী বীজ বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থসহ যাবতীয় আয় ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতে হবে। তবে ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের নিজস্ব আয়ের ৮০ শতাংশ অর্থ বিএডিসির কেন্দ্রীয় হিসাবে স্থানান্তর করা হলেও বাকি ২০ শতাংশ অন্য হিসাবে রাখা হয়েছে, যা বিএডিসি আইন ২০১৮-এর অষ্টম অধ্যায়ের ধারা ২৭ ও ৪২ (১) লঙ্ঘন।
জানা গেছে, অডিট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গত বছরের ১৫ জুলাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে নিরীক্ষা পরিদর্শন প্রতিবেদন (এআইআর) পাঠানো হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা তলবের জন্য বলা হয়। পরে গত বছরের ৬ জুলাই তাগিদপত্র ইস্যু করা হয়। এরপর অডিট আপত্তির আংশিক জবাব পাওয়া যায়। প্রাপ্ত জবাব গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ জবাব চেয়ে গত আগস্ট মাসে আধা-সরকারি পত্র পাঠানো হলেও আর কোনো উত্তর পায়নি অডিট কর্তৃপক্ষ। এ কারণে সরকারের ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা অপচয় হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৯ থেকে ২০২৪ অর্থবছরে ৩৬৫ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) অধীনে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খাল পুনঃখনন, ভূ-উপরিস্থ সেচ নালা, ভূগর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণ, রাবার ড্যাম নির্মাণ, হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম, ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন, গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুনর্বাসন, আর্টসিয়ান নলকূপ স্থাপন, সৌরশক্তিচালিত পাম্প ও টিউবওয়েল স্থাপন করার কথা রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কিছু কাজের অগ্রগতি হলেও তাতে নানা ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, পিডি মিজানের সিন্ডিকেট ছাড়া অন্য কোনো ঠিকাদার কাজ পায় না। এই ঠিকাদারি চক্রকে এককভাবে কোটি কোটি টাকার কাজ বণ্টন করে তিনি নিজেও বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছেন। প্রকল্প পরিচালক তার পছন্দের ঠিকাদারকে গোপনে টেন্ডারের আইডি ও প্রাক্কলিত দর সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেন। অন্য প্রকল্পে যেখানে প্রতি সেট পিভিসি পাইপ ৫ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে, সেখানে একই সময়ে কুমিল্লা প্রকল্পে কেনা হয় ৯ লাখ টাকায়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সময় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে প্রকল্প পরিচালক করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু বিধি-বহির্ভূতভাবে এবং ডিপিপি অনুসরণ না করে বিএডিসির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীকে প্রভাবিত করে একজন জুনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পের প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পর গত বছরের ২৯ মে বিএডিসির আট সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে পদোন্নতি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক-উপপ্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অথচ ১৯৯০-এর প্রবিধানমালা ১৫/৪ ধারা মোতাবেক পঞ্চম গ্রেডের ওপরে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অবশ্যই জ্যেষ্ঠতা বিবেচনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকল্প পরিচালককে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করার নির্দেশনা থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যের সুযোগে তিনি অধিকাংশ সময় ঢাকার বাসায় অবস্থান করেন বলে অভিযোগ আছে।
তথ্য বলছে, প্রকল্পের আওতাধীন তিনটি জেলার ৯টি কমপ্লেক্সের অফিস বা আবাসিক ভবন মেরামতে পাঁচ বছরের জন্য ১ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হলেও প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান দুই বছরের মধ্যে শুধু একটি কমপ্লেক্সের (কুমিল্লা) সংস্কারের জন্য ৯৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এ কাজের জন্য কোনো দরপত্র আহ্বান না করে আরএফকিউ পদ্ধতিতে নিজেই কাজটি করেন, যা সরকারি ক্রয় নীতিমালার পরিপন্থি।
জানা গেছে, মিজানুরের দায়িত্বকালে মাত্র আটটি গাছ বিক্রির অনুমোদন নিয়ে কুমিল্লা বিএডিসি কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরের অসংখ্য গাছ অবৈধভাবে কেটে বিক্রি করা হয়েছ। বিএডিসি ইউনিট অফিস নির্মাণের জন্য বিএডিসির সার ও বীজ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত জায়গার পুরোনো অবকাঠামো (চান্দিনা/মুরাদনগর/কসবা) অকেজো ঘোষণা ছাড়াই অবৈধভাবে বিক্রি করে দেন মিজানুর। এতে সংস্থাটি বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএডিসি চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত বছরের ১০ জুলাই বিএডিসির হিসাব বিভাগের হিসাব নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেনকে সদস্য করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ওই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
তদন্ত কমিটির সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘পিডি মিজানুর রহমানের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে কী উল্লেখ করা হয়েছে সেটি বলা যাবে না।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এগুলো তো আরও আগের কথা। নতুন প্রকল্পের দায়িত্ব পেতে পারি, তাই কিছু লোক আমার পেছনে লেগেছে। তারাই এসব বিষয় সামনে আনার চেষ্টা করছে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিএডিসির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদের মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কল করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে মেসেজ পাঠিয়েও কোনো উত্তর মেলেনি।