ঈদের দিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ মণ ওজনের মাংস দেওয়া একটি গরুর চামড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার রুপি এবং ১০ মণ ওজনের মাংস সরবরাহকারী গরুর চামড়া বিক্রি হয় ১ হাজার ২০০ রুপি পর্যন্ত। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতি রুপি ভারতীয় মুদ্রার মান বাংলাদেশি টাকায় ১ টাকা ৩৮ পয়সা। সেই হিসাবে দেশে পাঁচ মণ মাংস পাওয়া গেছে এমন একটি গরুর চামড়া ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩৮০ টাকা এবং ১০ মণ মাংস পাওয়া গেছে এমন গরুর চামড়া বিক্রি হওয়ার কথা ১ হাজার ৬৫৬ টাকার বেশি। অথচ সেই পরিমাপের গরুর চামড়া ঈদের দিন বাংলাদেশে বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৫৫০ থেকে ৬০০ এবং ৮০০ টাকায়।
অর্থাৎ ভারতীয় দামের তুলনায় দেশে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নেমেছে অর্ধেকে। অন্যদিকে দেশে লবণযুক্ত চামড়ার বর্গফুটপ্রতি দাম গতবারের চেয়ে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়ানোর পাশাপাশি ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি পিস চামড়ার সর্বনিম্ন দর ১ হাজার ২০০ এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ে সেই দাম অকার্যকরই থেকে গেছে। প্রচলিত আছে, কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থে রয়েছে গরিবের হক, যার ন্যায্যমূল্য দেওয়ার বিধান ধর্মেই বলা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দাবি, ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি’র মতোই এই দেশে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচায় এই বহুল প্রচলিত প্রবাদটির বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তাই তো মৌসুম এলেই কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে নয়ছয় হচ্ছে। যদিও এবার ঈদুল আজহার আগে ট্যানারি মালিক, চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানিকারক ও আড়তদাররা সমিতির পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে প্রতিশ্রুতি রাখা হয়েছিল যে, এখন থেকে তারা সেই ঠগবাজির ব্যবসা থেকে সরে আসবেন। এ লক্ষ্যে সদিচ্ছা দেখিয়ে সচিবালয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠক করে লবণযুক্ত চামড়ার বর্গফুটপ্রতি দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়ানোর পাশাপাশি ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়ার সর্বনিম্ন দর ১ হাজার ২০০ এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা নির্ধারণও করে দেন তারা। দাবি করেন, দেশেই চামড়ার চাহিদা আছে। সাভার ট্যানারিপল্লিতে ১৪২টি ট্যানারি এখন উৎপাদনে রয়েছে। চামড়া সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই যার যার অবস্থান থেকে নির্ধারিত দামে চামড়া কেনার প্রস্তুতি শেষ করেছেন। তিনি বলেছেন, এবার সার্বিকভাবে চামড়ার বাজার পরিস্থিতি ভালোই যাবে। তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঈদুল আজহার আগে চামড়া সংশ্লিষ্টদের এমন ঘোষণা মাঠপর্যায়ে প্রতিফলন ঘটেনি; বরং সারা দেশে ট্যানারি মালিকদের নিয়োজিত দালাল-ফঁড়িয়া এবং স্থানীয় আড়তদারদের পরিকল্পিত সিন্ডিকেট সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে দর ফেলতে নানা ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে। গরমে চামড়ার মান নষ্ট হয়ে গেছে, চামড়া পক্স সিনড্রোম রয়েছে, লেচকাট হয়েছে, কোথাও বেশি কাটা হয়ে গেছে, নিয়ে আসা হয়েছে দেরিতে, আড়তদার নেই, আড়তদার থাকলেও নগদ টাকা নেই, ট্যানারি মালিকরা আগের বকেয়া পরিশোধ করেনি–এমন হরেক অজুহাত তুলে নামিয়ে দেওয়া হয় চামড়ার দাম। এতে মাঠপর্যায় কোথাও কোথাও কেনার সময়ই খুব দাম হাঁকা হয়। উপায়ান্তর না দেখে অনেকে চামড়ার পচন ঠেকাতে কম দামেই চামড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কোথাও আবার এর উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। মৌসুমি চামড়া বিক্রেতারা তাদের সংগৃহীত চামড়া আড়তে নিয়ে পড়েন চরম বিপাকে। কারণ, দর ফেলতে আগেভাগেই স্থানীয় আড়তদাররা উধাও হয়ে যান। তারপর হঠাৎ করে উদয় হন কয়েক ঘণ্টা পর। এরপর তারা যে দাম বলেন, তাতে অনেকেরই মাথা হাত দেওয়ার মতো অবস্থা। যেখানে চামড়ার মোটামুটি দাম পাওয়া গেছে, সেটিও আবার বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে প্রায় অর্ধেকের সমান। কোথাও কোথাও তার চাইতেও কম। অর্থাৎ রাজধানী ছাড়া দেশের বেশির ভাগ জায়গায় পানির দরে বিক্রি হয়েছে চামড়া। আর সব মিলে সারা দেশে অন্তত ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জানান, চামড়ার দাম নির্ভর করে এর গুণগত মানের ওপর। যথাযথভাবে চামড়া ছাড়ানো, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা না গেলে চামড়ার মান অটুট থাকে না। ফলে তার দামও তেমন থাকে না। এজন্য চামড়া ছাড়ানোর কাজে সংশ্লিষ্টদের অনভিজ্ঞতা এবং অসচেতনতাই দায়ী। ছাগল ও খাসির চামড়া অনেক বেশি নষ্ট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাগলের চামড়া সংরক্ষণ করতে হাজার টাকা খরচ হয়। সেজন্য ঝুঁকি নিতে চান না ব্যবসায়ীরা। অসাবধানতাবশত চামড়া ছাড়াতে গিয়ে অন্তত ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসমএ) সভাপতি মো. আফতাব খান জানান, তারা চেষ্টা করেছেন নির্ধারিত দামের ফর্মুলা মেনে চামড়া আড়তে তুলতে। কারণ, বর্গফুটপ্রতি লবণযুক্ত চামড়ার যে দাম ধরা হয়েছে, সেখানে কাঁচা চামড়া কেনার পর ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা প্রক্রিয়াজাত খরচ আছে। সেই টাকা বাদ দিয়েও আমরা ঢাকায় গরুর চামড়া পিস ও মানভেদে ভেদে ১ হাজার ৩০০ টাকায়ও কিনেছি। আবার ৪৫০ টাকায়ও কিনেছি। ঢাকার বাইরের কথা বলতে পারব না, ঢাকায় আড়তদাররা কোনো সিন্ডিকেট করেনি বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের প্রাক্কালে ঈদের দিন ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন করেছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানা। এ সময় তিনি দাবি করেছেন, চামড়া শিল্প নগরীর সিইটিপিকে পুরোপুরি প্রস্তুত ও কার্যকর করা হয়েছে। এর সব মডিউলকে ওভারহোলিং তথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মেরামতপূর্বক ঢেলে সাজানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দিয়ে তরল বর্জ্যকে পরিশোধন করা হয়েছে। তাছাড়া বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রাথমিক পরিশোধন ছাড়া যাতে কোনো ট্যানারির বর্জ্য সিইটিপিতে আসতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে শিল্প সচিবের এ দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন, এখনো অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে ট্যানারির সিইটিপিসহ সার্বিক প্রক্রিয়াতে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোপুরি পরিবেশ সম্মত হতে পারছে না।
চামড়া সংগ্রহসহ সার্বিক বিষয়ে গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসেসিয়েশনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। সংগঠনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জানান, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর ও করোনা মহামারিসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের চামড়া খাতে। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। আর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি জানান, এবার সারা দেশে ৮০ লাখ পিস চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। তবে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়া করায় তিনদিনে কয়েক লাখ পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে।
এদিকে দাম না পেয়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে ছাগলের চামড়া। গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে পানির দরে। অভিযোগ রয়েছে, ট্যানারির মালিকরা গত কয়েকবছর ধরেই চামড়ার দাম দিচ্ছে না বলে মাঠপর্যায়ে এমন কমতি দরেই চামড়া কিনছেন ব্যবসায়িরা। ফলে এ উপজেলায় প্রতিটি গাভী গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা দরে এবং প্রতিটি ষাঁড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা দরে। চট্টগ্রামে দর ফেলতে পরিকল্পিত কারসাজিতে কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছেন স্থানীয় আড়তদাররা। মৌসুমি সংগ্রহকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে তারা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। ফলে লোকসান দিতে হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নষ্ট হয়ে যাওয়া ১০ হাজারেরও বেশি পিস চামড়া রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
শ্রীমঙ্গলে উপজেলাজুড়ে গরুর চামড়া সর্বোচ্চ দেড়শ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর ছাগলের চামড়া দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে। নাটোরের মোকামে প্রতি পিস ছাগলের চামড়া ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে গরুর চামড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা প্রতি পিস বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য জেলার তুলনায় নাটোরের চামড়ার দাম তুলনামূলক বেশি হলেও এই বাজার দর শুনেই অনেকেই চামড়া নিয়ে নাটোরমুখো হননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থায় নাটোরে চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ীদের। এবারের কোরবানির ঈদে এখানকার দুই শতাধিক আড়ত গরু ছাগল মিলিয়ে ৫০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
রংপুরে সিন্ডিকেটের ফাঁদে কমছে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম। নগরীর বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়। এতে লোকসানে পড়েছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। আর এবারও উপেক্ষিত হয়েছে নির্ধারিত দাম। হাতেগোনা কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফঁড়িয়ারা সামান্য লাভের মুখ দেখলেও কোরবানির চামড়ায় দায়সরা দরে কিনতে সব আয়োজন করেছেন স্থানীয় বড় বড় ব্যবসায়ীরা।
প্রতিবেদনটিতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও থানার স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।