গৃহযুদ্ধ হলো একটি দেশের ভেতরকার সশস্ত্র সংঘাত, যেখানে একই রাষ্ট্রের বিভিন্ন পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ে। এটি সাধারণত রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণে হয়ে থাকে। এতে শুধু রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত মতবিরোধ নয়, বরং এখানে অস্ত্র ব্যবহার করে একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়। এটি যে কোনো দেশের স্থিতিশীলতা ও জনগণের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। এ সংঘাতের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো—স্বজাতির বিপক্ষেই অস্ত্র ধরতে হয়। নিজেদের অস্ত্রে নিজেরাই ঘায়েল হতে হয়। আসলে এমন সংঘাতে কোনো পক্ষই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় না, কেবলই হারাতে হয়। গৃহযুদ্ধের বিস্তারিত নিয়ে লিখেছেন হুমায়ূন কবির
বিশ্বে কতটি দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে
এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে ১০ থেকে ১৫টি দেশে গৃহযুদ্ধ ব্যাপকভাবে চলছে বলে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে। কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড নামে একটি সংস্থা ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান দিয়ে বলছে যে ১৩টি দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। সেগুলো হলো—আফগানিস্তান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইথিওপিয়া, লেক চাদ বাসিন, সাহেল অঞ্চল (বুরকিনা ফাসো ও নাইজার), সোমালিয়া, সাউথ সুদান, সুদান, সিরিয়া, ইউক্রেন ও ইয়েমেন।
গৃহযুদ্ধের কারণ
এটি এক ধরনের যুদ্ধ, যা নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সাংগঠনিকভাবে দুই বা ততোধিক গোষ্ঠী যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। সাধারণভাবে গৃহযুদ্ধের ফলে রাষ্ট্র ভেঙে দুটি বা ততোধিক দেশও হয়ে যেতে পারে। আসলে এটি কেন হয়? রাষ্ট্রের নেতৃত্ব গ্রহণ বা দেশ পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মতানৈক্য হলে সংঘাত হয়। অনেক সময় নির্বাচনের ফল না মেনে নিলে এমন যুদ্ধের সূচনা ঘটতে পারে।
ফলাফল
গৃহযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তির প্রাণহানির পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ধরনের সংঘাত অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদে রূপ নেয়। অনেক সময় এটিতে বিভিন্ন পক্ষও অংশ নেয়। অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা যায়। আমরা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের ইতিহাস দেখি, তার বাস্তব ফল দেখতে পাই। ২০২১ সালে দেশটিতে তীব্র হওয়া গৃহযুদ্ধের ফলে আর্থিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
কয়েকটি বড় গৃহযুদ্ধ
বিশ্বের অন্যতম বড় গৃহযুদ্ধ হচ্ছে স্পেনের গৃহযুদ্ধ। ১৯৩৬ সালের ১৭ জুলাই শুরু হওয়া ওই যুদ্ধ চলে প্রায় তিন বছর। এতে পাঁচ লাখের মতো মানুষের প্রাণহানি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধও উল্লেখযোগ্য। ১৮৬১ সালে দেশটিতে সংঘটিত এ সংঘাত, যা মূলত দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ও ১১টি দাসনির্ভর অঙ্গরাজ্যের মধ্যে হয়। চার বছর ধরে চলা ওই সংঘাতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। আর ইংরেজ গৃহযুদ্ধ হয়েছিল ১৬৪২ থেকে ১৬৫১ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে কয়েক ভাগে। ইংল্যান্ডের সরকার ব্যবস্থায় রাজতান্ত্রিকতা অব্যাহত থাকবে না সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রূপ নেবে, এই ছিল এ বিরোধের মূল কারণ।
কেন কেউই জেতে না
গৃহযুদ্ধে সাধারণত কেউই জেতে না। কারণ, এটি স্বজাতির বিপক্ষেই ঘটে। কেবল দেশ বিভক্ত হয় না, বহু প্রাণহানি আর ক্ষয়ক্ষতিও হয়। আমরা যদি ইথিওপিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের দিকে লক্ষ্য করি, দেখতে পাই যে আফ্রিকার দেশটিতে টাইগ্রেদের সঙ্গে ইথিওপীয়দের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হলেও সংঘাত থামেনি, থামেনি মতপার্থক্যও। বরং তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সিরিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল হলেও সংঘাত থামেনি। গোষ্ঠীগত বিরোধ কমছে না। বাশার আল আসাদের গোষ্ঠী আলাইউদের সঙ্গে সংঘাতে কয়েক মাসে ব্যাপক হতাহত হয়েছে। দেশটির সুয়েইদা প্রদেশে দ্রুজ ও সুন্নি বেদুইনদের মধ্যে সংঘাত চলছে। এমন সংঘাতে আসলে জেতার কিছুই নেই।
এ সংঘাত আসলে দেশের অভ্যন্তরে হলেও এতে কোনো না কোনো বিদেশি স্বার্থ জড়িয়ে যায়। পরে দেশটিও বৈশ্বিক দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়। সুযোগে কর্তৃত্ববাদী শাসনও আরও নিপীড়ন চালায়। ক্রমে অসন্তোষ বেড়ে দীর্ঘায়িত হয় যুদ্ধ। এতে বিভক্ত সমাজ আরও বিভক্ত হয়।
মন্তব্য করুন