ইসলামী সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিকতার জগতে নক্ষতুল্য একটি নাম খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.)। তিনি নকশবন্দিয়া সুফি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.) ছিলেন মধ্য এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফি সাধক। মানুষের আত্মশুদ্ধি, অন্তর্দৃষ্টি, আল্লাহ স্মরণ এবং সমাজকল্যাণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তার সুফিবাদি ধারা।
খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.) ১৩১৮ খ্রিষ্টাব্দে (৭১৭ হিজরি) বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারার কাসর-ই-আরিফান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবকাল থেকেই ধর্মীয় প্রবণতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি গভীর আকর্ষণ দেখা যায়। অল্প বয়সেই তিনি প্রসিদ্ধ সুফি সাধক আমির কুলাল (রহ.)-এর সান্নিধ্যে আসেন এবং তার কাছ থেকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণ করেন।
বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.) ছিলেন খাজা মুহাম্মদ বাবাই সামাসি (রহ.) এবং পরবর্তীকালে আমির কুলাল (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী। ‘নকশবন্দ’ শব্দের অর্থ হলো ‘নকশা অঙ্কনকারী’ বা ‘চিহ্ন স্থাপনকারী’। বলা হয়, তিনি মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর স্মৃতির নকশা অঙ্কন করতেন, এজন্যই তাকে ‘নকশবন্দ’ বা ‘নকশবন্দি’ বলা হয়। তার উপাধি অনুসারে তার প্রবর্তিত সুফি তরিকার নাম হয় ‘নকশবন্দিয়া তরিকা’।
নকশবন্দিয়া তরিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘খাফি জিকির’ বা নিঃশব্দ আল্লাহস্মরণ। বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.) বিশ্বাস করতেন, অন্তরের গভীরে আল্লাহর নাম ধারণ করাই প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার মূল। তার তরিকার মৌলিক নীতিগুলোকে ‘আসল-ই-দশ’ (দশ মূলনীতি) বলা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. খলওয়াত দর আনজুমন তথা মানুষের ভিড়ের মাঝেও অন্তরে আল্লাহর দিকে ধ্যান। ২. ইয়াদ কারদ তথা হৃদয়ে সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণ। ৩. হুশ দাশত তথা মনঃসংযোগ ও চেতনা দ্বারা জিকির। ৪. বাজ গশত তথা সব কাজে আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন। ৫. নিগাহ দাশত তথা দৃষ্টি ও হৃদয়ের নিয়ন্ত্রণ।
খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.) শুধু তত্ত্বগত সাধনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি সমাজকল্যাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন। গরিব-দুঃখী, এতিম ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো ছিল তার নিত্য কাজ। তিনি জাগতিক ভোগবিলাসিতা থেকে দূরে থেকে সরল জীবনযাপন করতেন এবং শিষ্যদেরও একই শিক্ষা দিতেন।
১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে (৭৯১ হিজরি) বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.) ইন্তেকাল করেন। তার মাজার উজবেকিস্তানের বুখারায় অবস্থিত এবং আজও তা লাখ লাখ মুমিনের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। নকশবন্দিয়া তরিকা পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়া, ভারতবর্ষ, আনাতোলিয়া এবং আরব বিশ্বে বিস্তার লাভ করে এবং ইসলামী আধ্যাত্মিকতার অন্যতম প্রধান ধারা হয়ে ওঠে। তার শিক্ষা ও দীক্ষার ফল্গুধারা আজও মুসলিম সমাজে আত্মশুদ্ধি, নৈতিকতা ও আল্লাহস্মরণের অনুপ্রেরণা জাগিয়ে চলেছে। নকশবন্দিয়া তরিকা শুধু একটি সুফি ধারা নয়; বরং ইসলামী আধ্যাত্মিকতার গভীরতম মর্মবাণীর প্রতিফলন।
মন্তব্য করুন