আমরা এখন ডিজিটাল যুগে বসবাস করছি, বিশ্বায়নের পৃথিবীকে আলিঙ্গন করেছি। তথ্যপ্রবাহের অবাধ উৎস রয়েছে আমাদের সামনে, তথ্য অধিকার আইনে বাংলাদেশের নাগরিকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সব তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। কিংবা গুগলে সার্চ করলেই যে কোনো তথ্যের অপলাপ রোধ করা যেমন সম্ভব, ঠিক তেমনিভাবে সত্যকে জানা-বোঝা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সহজতর হয়েছে। আমরা শিগগির চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে ঝুঁকছি এবং এ যুগে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট মাধ্যমের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। আগত পৃথিবীতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ও ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে সব ধরনের ব্যবস্থাপনা নির্ধারিত হয়ে থাকবে অর্থাৎ হাতে-কলমে কাজ করার সুযোগ কমে লাগবে, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় সবকিছু পরিচালিত হবে। ক্যাশলেস প্রযুক্তির দিকে যাচ্ছি আমরা, যেখানে স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট অর্থনীতির বাস্তবতা রয়েছে। এ জায়গায় এসেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে উদ্ভূত অসংখ্য রিউমার অনেককে প্রলুব্ধ করেছে, অবিবেচক হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীর মৃত্যু সংবাদ ফেসবুকে এসেছে, পরবর্তী সময়ে ওই শিক্ষার্থী নিজে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানাতে হয়েছে তিনি বেঁচে আছেন। ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। অথচ যারা গুজব ছড়িয়েছে, তারা কিন্তু ফায়দা লুটে নিয়েছে, মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি চালু রেখেছে; শঙ্কা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে সাধারণ জনগণের মধ্যে। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে কোটা আন্দোলনে সৃষ্ট গুজবের মাধ্যমে। আমরা গুজব থেকে পরিত্রাণ চাই, গুজবের ভয়াবহতাকে সচেতনতার মাধ্যমে দূর করতে চাই। এর জন্য প্রয়োজন উদ্যোগের ও সহনশীলতার। শোনামাত্রই কিংবা ভিডিও অবলোকন করামাত্রই প্রচারিত সংবাদকে বিশ্বাস না করে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
গুজবের ভয়াবহতায় বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অসংখ্য জীবনের আত্মাহুতি ঘটেছে, ধ্বংস হয়েছে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও আধুনিক স্থাপনা। সংগত কারণেই গুজব কারা ছড়ায়, কেন ছড়ায়, কীভাবে ছড়ায়—এসবের কার্যকারণ নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার নজির সৃষ্টি করতে হবে। ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় গুজবকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিকতর তৎপরতা দেখায়। দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকায় অনলাইন মাধ্যমে সৃষ্ট গুজব ও গুজবের ভয়াবহতা জোরালোভাবে আমলে নিতে পারে না। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে দেখা যাচ্ছে, গুজব সৃষ্টিকারীরা তাদের কর্মকাণ্ডকে ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে, উঠতি বয়সী তরুণদের বিভ্রান্ত করছে। ফলে বিভ্রান্ত তরুণরা দিকভ্রান্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা করছে না। উদভ্রান্ত তরুণদের টার্গেট করেই দেশবিরোধীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিভাবকসহ দায়িত্বশীলদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতা ও সংঘর্ষের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই ভিপিএন সফটওয়্যারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে। যারা ফেসবুক ব্যবহার করছে তারা মিথ্যা তথ্য অপলাপের খোঁজ পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে গুজবকারীরা ফেসবুক দখল করে নিয়েছে। আবার অনেকেই এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কাদের আইডি থেকে ভুয়া তথ্য, ভুল মেসেজ সরবরাহ করা হচ্ছে, এসব প্রথম খুঁজে দেখতে হবে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যারা বিদেশে অবস্থান করছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের আইডি থেকে গুজব পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশে বসে অনেকে সেসব শেয়ার করে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেমন, বিদেশে বসে একজন ভিডিও লাইভ করছেন, আন্দোলনকারীরা ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের অফিস দখলে যাচ্ছেন। এটি কীভাবে সম্ভব? অথচ দেখা গেল আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে আন্দোলনকারীরা ছিল না। তদুপরি আগের কোনো ভিডিও এডিট করে সেটিকে আন্দোলন বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য এই ভিডিও দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন আবার কেউ কেউ অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। বিশেষ করে যারা সরকারবিরোধী, আওয়ামীবিরোধী জোটে রাজনীতি করছেন, তাদের কর্মী-সমর্থকরা বিপুল উৎসাহে ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নেওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। পরে দেখা গেল, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাহলে এ গুজব যারা সৃষ্টি করেছে, জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গুজবের রেশ শুধু ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে ব্যাপারটি তেমন নয়, কেননা এর আগে দেখা গেছে একটি গুজবের ঘটনা কেন্দ্র করে অসংখ্য ঘটনার উদ্রেক ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অন্যান্য জায়গায় আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুর ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে, অনেক জায়গায় ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের যারা প্রতিপক্ষ, রাজনীতির মাঠে সরকারকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ এবং যারা দেশবিরোধী তারা ফেসবুকে বোস্টিং পোস্টের মাধ্যমে গুজবকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে থাকে। বিশ্বের নামকরা টিভি মিডিয়া ও সংবাদপত্রে সরকারবিরোধী গুজবের ঘটনা অনেক আগেই দেখা গেছে, ডলার পে করে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। কাজেই বর্তমান সময় গুজবের উর্বর সময়, একটি অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশ এবং দেশের বাইরে। এ ধরনের শ্বাপদসংকুল পরিস্থিতিতে গুজবকারীরা সুযোগ লুফে নিচ্ছে। কাজেই এদের থেকে দূরে থাকতে হবে, সচেতন থাকতে হবে, দেশ ও দশের ক্ষতি হয় এমন কর্মকাণ্ড থেকে নিজে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যদের বিরত থাকতে অনুরোধ জানানো নৈতিক দায়িত্ব।
গুজব ছড়ায় মূলত ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিংবা দলের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। দেশবিরোধী একটি গোষ্ঠীর তৎপরতা সবসময়ই দেখা যায়, যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, সুযোগ পেলেই সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ইদানীংকালে লবিস্টের মাধ্যমে গুজবকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা সরকারের পতন হয় তথা সরকারের ওপর বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টি হয়—এ ধরনের উসকে দেওয়া বিভ্রান্তিকর সংবাদ বিশ্ব মিডিয়ায় পরিবেশিত হয় মূলত লবিস্টদের তৎপরতায়। এ ক্ষেত্রে লবিস্টদের তেমন দায় নেই। কেননা লবিস্টদের সঙ্গে চুক্তিপত্র করা হয় এ মর্মে, যেখানে গ্রাহকের শর্ত মেনে সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। গ্রাহকের শর্তেই হচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে এমন সব নিউজের অবতারণা করা, যার মাধ্যমে সরকারকে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে, সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হতে হয়। এমন প্রচেষ্টা বহুবার হয়েছে সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক তৎপরতায় সত্যকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন কোটা আন্দোলন ঘিরে গুজবকারীরা আবার সুযোগ লুফে নিয়েছে, সরকারবিরোধী গ্রুপ এ গোষ্ঠীটিকে মদদ দিচ্ছে।
গুজব মূলত তারা, রোটেন পকেটের মধ্য দিয়ে ছড়ায়। রোটেন পকেট মূলত একটি টিম হিসেবে কাজ করে, যাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এক, অভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা কাজ করে। অর্থাৎ এমন একটি গ্রুপ তৈরি করে যারা একে অন্যের পরিপূরক এবং তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় কাজটি হয়ে থাকে। একই আদর্শ, একই উদ্দেশ্য, একই লক্ষ্য ও অভিলক্ষ্য ইত্যাদি সামনে রেখে রোটেন পকেট কাজ করে থাকে। সাধারণত নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালনের ক্ষেত্রে রোটেন পকেটের উদ্ভব হয়ে থাকে। ইউটিউবে ভিডিও আকারে প্রকাশিত সংবাদগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে কেটে একসঙ্গে এমনভাবে সাজানো হয়, মনে হয় সাজানোকৃত ভিডিওটি প্রকৃত ভিডিও। সুপার এডিট করে ভিডিওগুলো উপস্থাপন করা হয়, যেখানে সাধারণের পক্ষে বাছবিছার করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এখন বাংলাদেশে যারা এসব বিভ্রান্তিকর সংবাদ সময় নিয়ে দেখে, তাদের অনেকেই সত্য-মিথ্যার যাচাই এর ক্ষেত্রে চিন্তাশীল নয়, সে কারণেই তারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অন্যদেরও ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি করে। অর্থাৎ সংবাদ শোনা ও দেখার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের সম্পদ আমাদের সবার, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা খাটো হলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। সংগত কারণেই গুজব সৃষ্টিকারী ও গুজব প্রচারকারীদের প্রতিহত করতে হবে সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়