নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ননস্টপ ইন্টারনেট নিশ্চিতকরণ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিং কল্পনাও করা যায় না সেটা এই সেক্টরের প্রতিটি মানুষই জানেন। ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে রিমোট জব এবং এর জন্য অবশ্যই ভার্চুয়াল জগতে সক্রিয় থাকাটা অবশ্যিক বিষয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ত্রুটিযুক্ত ইন্টারনেট সেবা নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং জগতে বিরাট কিছু করার স্বপ্ন দেখা আর সাগরে সেচপাইপ লাগিয়ে পানি শুকানোর চেষ্টা করাটা একই কথা।
আমি ওডেস্ক (Odesk) থাকাকালে থেকেই টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে টানাহেঁচড়া করলেও আমি ফ্রিল্যান্সিংটাকে একদম ফুলটাইম পেশা হিসেবে নিতে পেরেছি গত চার বছর। আমি কাজ করি আপওয়ার্কে। আমার জানামতে, আপওয়ার্ক খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে কাজ করতে প্রতিটি মুহূর্তে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এটিএম বুথের মতো ২৪/৭ বায়ার রেসপন্স করার জন্য অ্যালার্ট থাকতে হয়। হাজারো নির্ঘুম রাতের গল্প একজন ফ্রিল্যান্সারের চোখে ভেসে বেড়ায় অনবরত। আমি ডিজাইন নিয়ে কাজ করি। আমি যথেষ্ট রিচার্স করেছি এই আপওয়ার্কে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য। ইউটিউবিংসহ বিভিন্ন সফল ফ্রিল্যান্সারদের জীবনী এবং তাদের লেখা পরামর্শমূলক বই পড়ার চেষ্টা করেছি। কাজের স্কিল ডেভেলপমেন্ট তো অবশ্যই জরুরি। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভালো ক্লায়েন্ট ধরতে পারা। আর তার থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ক্লায়েন্ট পাওয়ার পর সেটাকে ধরে রাখা। ঠিক যেমন স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা কঠিন। ঠিক তেমনি এই বেলাও তাই। আমি চার বছরে প্রায় ৩০০ প্লাস ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করেছি। এই তিন শতাধিক ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করে আমি যে অভিজ্ঞতাটা পেয়েছি, সেটা হলো বিদেশিরা বেশিরভাগই খুবই রুটিনমাফিক জীবনযাপন করেন এবং প্রতিটি কাজের বেলায় তারা খুবই সিরিয়াস থাকে। হাতেগোনা দু-চারজন একটু বাজে রুটিন বা স্বভাবের হয়ে থাকে। তারা টাইম মেইনটেইনে কাউকে কোনো কম্পোমাইজ করতে চান না সহজে। Quick Response একটা বড় বিষয় ফ্রিল্যান্সিংয়ে। বায়ার সবসময় চান Quick turnover এবং আমরা কাজ নেওয়ার সময় যেটা হয় আমরা বলি সব সুবিধা দেব। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেটার আমি মুখোমুখি হয়েছি সেটা হলো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা Quick Response/ Quick turnover দিতে পারি না। বিদ্যুৎ চলে গেলেই ব্রডব্যান্ড বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে পিসিও বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ল্যাপটপ কিছুটা ব্যাকআপ থাকে কিন্তু নেট ছাড়া ব্যাকআপ সম্পূর্ণই প্যাকআপ। যার জন্য ব্রডব্যান্ডের সঙ্গে সঙ্গে সিমেও নেট কিনতে হয় আমাদের; কিন্তু তাতেও সমস্যা। সিম কোম্পানিগুলোর নেটের যে লাগামছাড়া দাম, সেটা অবশ্যই একজন ফ্রিল্যান্সারের সাধ্যের বাইরে না হলেও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ইন্টারনেট কেনা বেদনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাজে রকমের দাম আমাদের সিম কোম্পানিগুলোর ইন্টারনেট প্যাকেজ।
গ্রামাঞ্চল থেকে তো ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা চিন্তা করাও পাপ বলে আমার মনে হয় এখন। কারণ বিদ্যুৎ থাকে না বললে যথেষ্ট ভুল হবে, আসলে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ যে কখন থাকে, সেটাই বোঝা কঠিন। আর যদি পশ্চিমাকাশে একটা কালো মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়ে, তাহলে আর সপ্তাহখানেকের জন্য বিদ্যুৎ গায়েব হয়ে যায়। আমি যতবারই ঢাকা ছেড়ে বাড়ি গিয়েছি অবসর কাটাতে, ঠিক তখনই রানিং বায়ার আমার কাজে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সন্তুষ্ট হতে পারবেনই-বা কীভাবে, কারণ গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ তো থাকেই না; তারপর কারেন্ট চলে গেলে সিম কোম্পানিগুলোর নেটও স্লো হয়ে যায় অটোমেটিক।
আপওয়ার্কে ইউক্রেনের ফ্রিল্যান্সার খুব ভালো একটা দাপট রয়েছে। আমি অনেক কাজেই বিশেষ করে ভালোমাপের ডলার খরচ করা বায়ারগুলোকে দেখেছি—কাজ পোস্ট করে উল্লেখ করেই দেন যে তিনি ইউক্রেনের ফ্রিল্যান্সার নেবেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সময় দেখেছি, আপওয়ার্ক প্রতিটি ফ্রিল্যান্সারকে মেইল করে জানায়, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের ফ্রিল্যান্সারা কিছুটা সমস্যায় আছে। তাদের বিষয়ে আপওয়ার্ক অনেক শিথিলতা দেখিয়েছিল। আপওয়ার্ক তাদের ওয়েবসাইটের মেইন স্লাইডে বারবার দেখাচ্ছিল, ইউক্রেনের ফ্রিল্যান্সারের জন্য খুবই উদ্বেগ ও সমবেদনা। আমি তখন রিসার্চ করে বুঝেছিলাম ইউক্রেনের ফ্রিল্যান্সারদের কেন একটু স্পেশাল দৃষ্টিতে দেখা হয়। কারণ হিসেবে প্রথমে পেয়েছি তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা, সেটা হলো ইউক্রেনের ইন্টারনেট সিড স্ট্যাবিলিটি খুবই দারুণ এবং মানসম্মত পর্যায়ের এবং ইউক্রেনের সরকার ও ইন্টারনেট কোম্পানি থেকেও বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে ইউক্রেনিয়ান সব ফ্রিল্যান্সারকে। কিন্তু আমাদের দেশের সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়। সব সেক্টর তথা দেশের সব ক্ষেত্রেই ক্ষতি হয়েছে সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই সামগ্রিক। কিন্তু এই দীর্ঘমেয়াদি, অনিশ্চিত ইন্টারনেট সেবা বন্ধের জন্য হাজারো বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারের সাজানো সংসার এখন সর্বনাশা পদ্মার নদীতে ভেঙে যাওয়া মানুষগুলোর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার ছয় মাস বা এক বছর কাজ করছি এমন বায়ার হারিয়েছি তিনটির মতো। যেটা আমার জন্য আকাশসম বেদনার, কষ্টের। কারণ বায়ারগুলো আমার কাজে এবং টাইম মেইনটেইনসহ অল অ্যান্ড এভরিথিং নিয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু হঠাৎ কোনো কিছু না বলেই হারিয়ে যাওয়টা এবং দীর্ঘমেয়াদি তাদের মেসেজ রিপ্লাই না করার জন্য তারা কাজ উঠিয়ে নিয়ে অন্য ফ্রিল্যান্সার হায়ার করেছেন।
আমাদের আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর ফেসবুক পেজ ফলো করতাম আমি। আমি তার প্রোফাইলে আপডেট জানতে চেষ্টা করতাম কারণ তাকে দেখতাম প্রায়ই ফ্রিল্যান্সার এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করার বুলি ওড়াচ্ছেন গত কয়েক বছর। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ভদ্রলোক শুধু আয়মান সাদিকদের জন্যই কাজ করেন দিনশেষে। অনেকটা তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো। তার সোশ্যাল মিডিয়ার ছবিগুলোতে নকল, কৃত্রিম হাসির ছড়াছড়ি। হাসিতে ন্যাচারাল কোনো ভাব-ভঙ্গিমার বালাই না থাকলেও ভদ্রলোক হেসেই থাকেন সবসময়। কিন্তু আমাদের মতো উদীয়মান ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এরকম কৃত্রিম দুর্ভোগ কখনো কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। রাজনৈতিক রেষারেষির ঊর্ধ্বে এ বিশ্বের কোনো দেশই নয়। রাজনৈতিক ঠেলাঠেলি থাকবেই। কিন্তু তার জন্য দেশের হাজারো তরুণের তিল তিল করে গড়া স্বপ্নকে ছোট করে দেখা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
আমাদের মতো দেশের এরকম প্রতিকূলতার মধ্যেও যে এত ফ্রিল্যান্সার বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় নিজেদের দেশের হয়ে প্রতিযোগিতা করে ডলার ইনকাম করে দেশে আনছেন সেটা নিশ্চয় প্রশংসার বিষয়। তাই আমি দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত আবেদন জানাব, অবশ্যই দেশের ফ্রিল্যান্সারদের কথা মাথায় রেখে এমন কিছু বিষয় চালু করার, যেগুলো দেশের ফ্রিল্যান্সারদের উৎসাহ জাগানোর সঙ্গে বিশেষ কিছু সুবিধাও দেবেন। যেমন ধরুন ফ্রিল্যান্সারের জন্য সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু করা। দেশের সব সেক্টরের ইন্টারনেট বন্ধ থাকরেও যেন কোনো না কোনোভাবে ফ্রিল্যান্সাররা তাদের কাজ চালাতে পারেন, সে পরিমাণ ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত রাখা। এ ছাড়া দেশের সিম কোম্পানিগুলো যাতে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বিশেষ ছাড়ে কিংবা বিশেষ সুবিধা প্রদান সাপেক্ষ সাশ্রয়মূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করেন, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা।
যে দেশ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে নিমিষে, সেই স্মার্ট দেশ অবশ্যই ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এই ননস্টপ মানসম্মত স্পিডের ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে পারবেন বলে বিশ্বাস রাখি। অন্যথায়, এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে একসময় বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা তাদের চাহিদা হারিয়ে ফেলবেন এই প্রতিযোগিতার বাজারে। বিদেশি ক্লায়েন্টদের ভেতরেও একটা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হবে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি। যেটার প্রভাবে এ দেশের হাজারো তরুণ সফল ফ্রিল্যান্সারের চেয়ার থেকে ছিটকে পড়ে পথে বসে যাবেন নিমিষে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স লেখক
নিকুঞ্জ-২, খিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯