বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। এসব পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আমাদের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট স্থাপত্যগুলো। ভবিষ্যতের স্থাপত্যগুলো কীভাবে এ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে এবং এগুলো রক্ষা করা কতটুকু সম্ভব, সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, আমাদের স্থাপত্যগুলো পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থাপত্য ডিজাইন এবং নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পরিবেশবান্ধব উপাদান ও কৌশলগুলোর প্রয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্থাপত্যের ইতিহাস প্রাচীন ও বৈচিত্র্যময়। আমরা মসজিদ, মন্দির, রাজবাড়ী এবং ঔপনিবেশিক আমলের ভবনসহ অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সাক্ষী। এ স্থাপত্যগুলো শুধু আমাদের ঐতিহ্য নয়, বরং আমাদের পরিচয়ের অংশ বটে।
পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলাবদ্ধতা প্রায়ই ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব দুর্যোগের তীব্রতা ও ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের স্থাপত্যগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ লবণাক্ততা ইট ও পাথরের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে, যা ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ক্ষতি করছে। উদাহরণস্বরূপ, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো স্থাপনাগুলো এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং বন্যার কারণে স্থাপত্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে ফেলছে।
একটি সুদৃঢ় ও টেকসই স্থাপত্যের মূলনীতি হলো তার অবস্থান নির্ধারণ করা এবং সেখানকার প্রাকৃতিক উপাদানগুলো বিবেচনায় নেওয়া। উদাহরণস্বরূপ—বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ভবনগুলোকে উচ্চস্তরের প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্মাণ করা প্রয়োজন, যাতে বন্যার পানি সহজে প্রবেশ করতে না পারে। এ ছাড়া বায়ুপ্রবাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের সুযোগ রাখতে হবে। পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপকরণ যেমন বাঁশ, মাটি এবং স্থানীয় কাঠ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য তৈরি করা সম্ভব। স্থানীয় উপকরণগুলো পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত মিশে যেতে পারে এবং এগুলোর মাধ্যমে পরিবেশের ওপর চাপ কমানো যায়। বাংলাদেশের অনেক গ্রামীণ এলাকায় এখনো মাটির ঘর এবং বাঁশের ব্যবহারে নির্মিত বাড়ি পাওয়া যায়, যা খুবই টেকসই ও পরিবেশবান্ধব।
তবে আধুনিক স্থাপত্যের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কাচ, কংক্রিট ও ইস্পাতের মতো উপকরণ ব্যবহারে পরিবেশের ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। এ কারণে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের জন্য গবেষণা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। গ্রিন বিল্ডিং কনসেপ্ট, যেখানে সৌরশক্তি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক আলো ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তির অপচয় কমানো হয়, তা পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক গ্রাম ও শহর হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য স্থাপত্যে উদ্ভাবনী সমাধানের প্রয়োজন। ভাসমান বাড়ি এবং সেতুর ডিজাইন, যা পানির স্তরের সঙ্গে উচ্চতা সামঞ্জস্য করতে পারে, এ ক্ষেত্রে একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শহুরে এলাকায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ভবিষ্যতের শহুরে স্থাপত্যগুলো খোলা স্থান, সবুজায়ন এবং পানি সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষ করে, শহরের উচ্চ ভবনগুলোয় সবুজ ছাদ (Green Roof) এবং ভার্টিক্যাল গার্ডেনের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার শহরের পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ কারণে অনেক অঞ্চলে অত্যধিক তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা না থাকায় স্থাপত্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই তাপ নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ু প্রবাহের জন্য ডিজাইন কৌশলগুলো প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ—পুরু দেয়াল, ছায়ার জন্য বাড়ির ওপর বা চারপাশে গাছ লাগানো এবং প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের জন্য জানালার অবস্থান নির্ধারণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান স্থাপত্য প্রেক্ষাপটে আরও কিছু বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। ঢাকা শহরের মতো দ্রুত নগরায়িত শহরে অপ্রতুল অবকাঠামোর এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে জলাবদ্ধতা ও বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা মোকাবিলার জন্য সঠিক ড্রেনেজ সিস্টেম এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কৌশলগুলো স্থাপত্যে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রাচীন স্থাপত্যগুলো সংরক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় পুরোনো স্থাপত্যগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব। যেমন, পুরাকীর্তি অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সংরক্ষণ সংস্থা ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলোর পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছে। তবে এ কাজগুলো আরও সমন্বিত ও ব্যাপক আকারে করা প্রয়োজন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করে দেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো সংরক্ষণ করতে পারে। এ কাজে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পর্যাপ্ত অর্থায়ন। একই সঙ্গে গবেষণা ও শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ স্থপতি এবং ইঞ্জিনিয়ারদের পরিবেশবান্ধব নির্মাণ প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করতে হবে।
পরিবেশ বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে আমাদের স্থাপত্যগুলো রক্ষা করার জন্য একটি সমন্বিত ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং যথাযথ সংরক্ষণ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের স্থাপত্যগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ নিই, তবে আমাদের স্থাপত্যগুলো শুধু পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে না, বরং আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
পরিশেষে, আমাদের স্থাপত্যগুলো পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য বহুমুখী কৌশল গ্রহণের প্রয়োজন। স্থানীয় উপকরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার, পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ডিজাইন কৌশল এবং আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা স্থাপত্যগুলো আরও টেকসই করতে পারি। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এসব স্থাপত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে জানানো জরুরি। শুধু একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্থাপত্যগুলো ভবিষ্যতের পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হব।
লেখক: স্থপতি, শিক্ষক (স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ও স্থাপত্য পরিবেশবিষয়ক গবেষক