সম্প্রতি উজানের দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টির কারণে দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা আঘাত হানে। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এবং আগাম কোনো সতর্কবার্তা বা পূর্বাভাস না থাকার কারণে তীব্র বন্যার পানির স্রোত মুহূর্তের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের বাসস্থানসহ ঘরের খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, জমির ফসল, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগির খামার, পুকুর-জলাশয়ের মাছ। বন্যায় মারা যায় কমপক্ষে ৬০ জন মানুষ, শূন্য দশমিক ৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। প্রায় ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ এই ভয়াবহ বন্যার কবলে আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি জেলা হচ্ছে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট।
সার্বিকভাবে বন্যায় ১১টি জেলায় কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা এখনো হয়তো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে, এই ক্ষতির পরিমাণ কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহায়তা ছাড়া দেশের একার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তা অত্যন্ত পরিষ্কার। কারণ, এই বন্যা শুধু ১১টি জেলারই ক্ষতি করেনি; বরং সারা দেশের অর্থনীতিতে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে স্বাভাবিকভাবেই। কাজেই, জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিতে হবে বন্যার এই বিশাল ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য। দীর্ঘমেয়াদি কৃষির উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং এর সঠিক ও যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অবশ্যই আমরা দেশের এই ব্যাপক পরিমাণ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। এখন থেকেই যেসব কৃষির উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ—
এক. আমন চাষের ওপর প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নেওয়া: বন্যা আক্রান্ত ১১টি জেলায় স্বাভাবিকভাবে আমন মৌসুমে কয়েক লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়, যা এবারের এই বন্যায় আমন ফসলের ক্ষতির পরিমাণ অনেক। কারণ, এই ১১টি জেলায় এরই মধ্যে আমন লাগানো প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। আমন ফসলের এই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে নাবি জাতের আমনের চাষ যতটুকু বাড়ানো যায়, তার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া দরকার। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানা যায়, দেশে এই মুহূর্তে খুব বেশি পরিমাণে নাবি জাতের আমনের বীজ নেই। তবে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এরই মধ্যে ৭০০ থেকে ৭৫০ মেট্রিক টন নাবি জাতের আমনের বীজ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে এবং ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেতর খালি জায়গায় বীজতলাও করা হয়েছে। তাদের সংগৃহীত জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বিআর-২৩, ব্রি ধান-৭৫ এবং বিনা-১৭। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নাবি জাতের আমনের বীজতলা করেছে, যা দিয়ে প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত আমনের চারা দিয়ে প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমিতে লাগানো যাবে। তা ছাড়া কিছু পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান তাদের তত্ত্বাবধানে কিছু নাবি জাতের আমনের চারা উৎপাদন করছে, যা দিয়ে আরও কিছু পরিমাণ জমি আমন চাষের আওতায় আসবে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তলিয়ে যাওয়া আমনের জমিতে আগে লাগানো চারা বা চারার গোড়াও যদি বেঁচে থাকে, সেসব জমি পরিষ্কার করে দ্রুত ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে তা থেকেও ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। যেহেতু, বন্যায় আক্রান্ত সব কৃষক তাদের সর্বস্ব হারিয়েছেন, তাই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমন চাষের প্রয়োজনীয় সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিনা মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
দুই. শীতকালীন শাকসবজির চাষ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেওয়া: বন্যায় আক্রান্ত ১১টি জেলায় উৎপাদিত প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকার বাজারে আসে এবং ঢাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের চাহিদা মেটায়। শাকসবজির চাষ এসব জেলার কৃষকের নগদ অর্থ আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। শীত মৌসুমে যেসব সবজির চারা তৈরি করার প্রয়োজন হয়, নিশ্চয়ই এ মুহূর্তে বেশ কয়েকটি জেলায় সেই বীজতলা করার মতো জায়গা এবং বন্যাক্রান্ত কৃষকের সামর্থ্য—কোনোটাই নেই। এসব জেলায় সেপ্টেম্বর মাস থেকেই শীতকালীন শাকসবজির চাষ শুরু হয় বাজারে আগাম তোলার জন্য।
এ অবস্থায় এই জেলাগুলোর বিগত মৌসুমের শস্য উৎপাদন তালিকা দেখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সবজির চারা উৎপাদনের কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে অন্যান্য শাকসবজির মানসম্পন্ন বীজ প্রস্তুত রাখা জরুরি, যাতে কৃষকরা জমির পানি নেমে যাওয়ার পরপর জমি চাষ করে প্রয়োজনীয় শাকসবজি লাগাতে পারেন। যথেষ্ট পরিমাণে সবজির চারা কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করার জন্য বিএডিসির হর্টিকালচার সেন্টার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নার্সারি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠ ব্যবহার করা যেতে পারে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে শীতকালীন শাকসবজির চাষ বরাবরের মতো অব্যাহত রাখার জন্য কতিপয় করণীয়:
বন্যাক্রান্ত জেলার জন্য যেসব শাকসবজির বীজ ক্রয় করা হবে, অবশ্যই তা যাতে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ হয়, সেটা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা। কারণ আমরা সম্ভবত এখনো অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্র থেকে বের হতে বা মুক্ত হতে পারিনি। তাই সর্বপ্রথম নিশ্চিত হতে হবে, যাতে ক্রয়কৃত বীজ ভালো মানের হয়।
পর্যাপ্ত এবং চাহিদা অনুযায়ী উন্নত জাতের সবজির বীজতলা স্থাপনপূর্বক কৃষকের তালিকা তৈরি করা এবং চাহিদা অনুযায়ী কৃষককে সময়মতো সবজির চারা সরবরাহ করা।
যেহেতু বন্যা কৃষকের ঘরবাড়িসহ সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, সেহেতু প্রয়োজন অনুযায়ী জমি তৈরির জন্য ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শুধু অসহায় কৃষকের প্রয়োজনে নয়, সার্বিকভাবে দেশের মানুষের খাদ্যের জোগান অব্যাহত রাখতে বন্যার এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এই বন্যায় কৃষক একবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাই তাদের কৃষিকাজের তথা দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদনের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের মানসম্পন্ন রাসায়নিক সার, জৈব সার, পেস্টিসাইড ইত্যাদি বিনামূল্যে প্রণোদনার মাধ্যমে প্রদান করতে হবে।
তিন. আগামী বোরো মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি ও করণীয়: যেহেতু আকস্মিক বন্যার স্রোতে কৃষকের সব সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে রাখা বোরো ধানের বীজ ভেসে গেছে অথবা নষ্ট হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বন্যাক্রান্ত ১১টি জেলাতেই কৃষকের হাতে আর তেমন বীজ সংরক্ষিত নেই। পাশাপাশি গত জুন-জুলাই সময়ে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় এবার দেশে আউশ ও আমনের ফলনে কিছুটা হলেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে, যা সার্বিকভাবে ধানের উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই বন্যায় আক্রান্ত ১১টি জেলার আউশ এবং আমন ধানের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সেইসঙ্গে সারা দেশের বাস্তবতায় আগামী বোরো মৌসুমে ধান চাষের এলাকা অবশ্যই বাড়াতে হবে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য। এজন্য প্রয়োজন চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন বীজের। এখনই হিসাব কষে নিতে হবে, দেশে আগামী বোরো মৌসুমের জন্য বিএডিসি এবং প্রাইভেট সেক্টর মিলিয়ে মোট বীজের পরিমাণ এবং প্রয়োজনে আমদানি করে আনতে হবে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ।
বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের বোরো বা আমন যে কোনো একটি মৌসুমের ফসল আংশিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে স্বাভাবিকভাবেই। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে এশিয়ার ধান উৎপাদনকারী অধিকাংশ দেশের বাস্তবচিত্র প্রায় একই রকম। প্রতিটি দেশ এখন তার নিজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জোর দিচ্ছে। কারণ, এরই মধ্যে প্রতিটি দেশে ধানের ফলন জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে বিগত বছরগুলোর তুলনায় কমে গেছে। তাই টাকা থাকলেও খাদ্য আমদানি করা আগামী দিনের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই, নিজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নির্ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া হবে অত্যন্ত সময়োপযোগী কাজ।
লেখক : এগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ