ড. এম মনির উদ্দিন
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ এএম
আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ধানের ফলন বাড়বে কীভাবে

ধানের ফলন বাড়বে কীভাবে

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ যার প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন। প্রতি বছর আবাদি জমি কমছে ১ শতাংশ এবং নতুন জনসংখ্যা বাড়ছে ২ মিলিয়ন। তাই আগামীতে কম পরিমাণ জমি থেকে অধিক ফসল ফলাতে হবে অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্যের জন্য। গত দুই দশকে (২০০১-২০২০) দেশের কৃষি উৎপাদন প্রতি বছর ৩.৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যা দেশের জিডিপির প্রায় ১৭ শতাংশ। এর ফলে দারিদ্র্য কমে আসে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং কৃষিতে ৪১ শতাংশ শ্রমশক্তি কর্মসংস্থানের আওতায় আসে।

দেশে সবুজ বিপ্লবের ২০ বছরের মধ্যে উন্নত জাতের সম্প্রসারণ, ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো এবং নিবিড় উপকরণ ব্যবহারের ফলে ধানের ফলন দ্বিগুণ হয়েছে। ফলস্বরূপ, সত্তর ও আশির দশকে ধান উৎপাদন প্রতি বছর ২.৩-২.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। নব্বইয়ের দশকে বৃদ্ধির হার ১.৫ শতাংশে নেমে আসে এবং একুশ শতকের প্রথম দশকে প্রধানত জলবায়ুর পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় ও উর্বরতা হ্রাসের কারণে আরও কমে আসে।

বাংলাদেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের বৃহত্তম উৎসগুলোর মধ্যে কৃষি অন্যতম। ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, ধান চাষ কৃষি থেকে নির্গত মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখে। ভাত বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য এবং বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ধান চাষের জমি থেকে যে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমন হয় তার মধ্যে মিথেন; কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২৮ গুণ বেশি দায়ী। আর নাইট্রাস অক্সাইড; কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় ২৯৮ গুণ বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে। ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে, দেশে মোট মিথেন নির্গমন ছিল ৫৭.২ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড সমপরিমাণ, যেখানে কৃষি ও ধান চাষ থেকে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমন ছিল ৩৩.৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড সমপরিমাণ।

ইউরিয়া সারের অপচয় রোধ তথা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলতে থাকে, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আশির দশকে ইউরিয়া সারের অপচয় রোধের ওপর গবেষণা চালিয়ে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যার মাধ্যমে ইউরিয়া সারের অপচয় কমিয়ে আনা যায় এবং এতে প্রায় ৪০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় হয়। সারের কার্যকারিতা বেড়ে যাওয়ায় ধানের ফলনও ২৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। গুঁড়া ইউরিয়াকে ব্রিকোয়েট মেশিনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে ন্যাপথলিনের মতো গুটি ইউরিয়া তৈরি করা হয়, যার ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি গুটি বোরো ধান লাগানোর ৭-১৫ দিনের মধ্যে প্রতি চার গোছার মাঝখানে ৭-১০ সেমি গভীরে পুঁতে দেওয়া হয় আর আমনের ক্ষেত্রে একইভাবে ১.৮ গ্রামের একটি গুটি ব্যবহার করা হয়। এতে বোরো ধানে হেক্টরপ্রতি গুটি ইউরিয়ার দরকার হয় ২৪০ কেজি (১০ ইঞ্চি × ৬ ইঞ্চি দূরত্বে) আর আমনের ক্ষেত্রে দরকার হয় ১৫০ কেজি।

গুটি ইউরিয়া একবার ব্যবহার করলেই ধান কাটা পর্যন্ত আর ইউরিয়া সার ব্যবহার করা দরকার হয় না এবং গাছে ইউরিয়াজনিত গুপ্তক্ষুধা থাকে না। গুটি ইউরিয়া যেহেতু মাটির নিচে পুঁতে দেওয়া হয়, ফলে আগাছা সারের ওপর ভাগ বসাতে পারে না। এর ফলে আগাছার পরিমাণ খুবই কমে যায়, যা নিড়ানি খরচ কমাতে সহায়ক হয়। অথচ গুঁড়া ইউরিয়া ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে ধানগাছের আগে আগাছা সার গ্রহণ করার সুযোগ পায়, কারণ আগাছার শিকড় মাটির ওপরের দিকে থাকে এবং এতে যতবার ইউরিয়া সার ছিটানো হয় ততবার নিড়ানি দরকার হয়। গুটি ইউরিয়ার ক্ষেত্রে একটি নিড়ানিই যথেষ্ট। ধানের শিষ উৎপাদন পর্যায়ে যদি নাইট্রোজেনের অভাব বা গুপ্তক্ষুধা থাকে, তাহলে ফলন অনেক কমে যায়। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ধানগাছ সবসময় তার প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন পায় বিধায় শিষ উৎপাদন পর্যায়ে নাইট্রোজেনের কোনো অভাব থাকে না। এর ফলে ফলন বেড়ে যায়। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করা জমিতে গুছিতে শিষবাহী কুশির সংখ্যা বেড়ে যায়, দানার আকার পুষ্ট হয় যার কারণে বেশি ফলন পাওয়া যায় এবং পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করায় দানায় অ্যামাইনো অ্যাসিড বেড়ে যায়, যা প্রোটিন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে নাইট্রোজেনের অপচয় কমিয়ে দেয়, যা ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে সহায়ক।

প্যারিস চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শর্তসাপেক্ষে ১৫ শতাংশ এবং শর্তহীনভাবে ৫ শতাংশ শক্তি, পরিবহন ও শিল্প খাত থেকে নির্গমন কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্ব যদি উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের ২০৫০ সালের মধ্যে জিডিপির ২ শতাংশ এবং ২১০০ সালের মধ্যে জিডিপির ৯.৪ শতাংশ বার্ষিক ক্ষতি হতে পারে। এজন্য বাংলাদেশ বিশ্বে তার ভূমিকা পালন করতে চায়।

এডব্লিউডি সেচব্যবস্থা পানির সাশ্রয় করে ৩০ শতাংশ, মিথেন নির্গমন ৩৭ শতাংশ হ্রাস করে, ধানের ফলন ১৫ শতাংশ বাড়ে, জমিতে প্রয়োগকৃত সারের অপচয় কমে, জ্বালানি খরচও কমে। কিন্তু তারপরও কৃষক পর্যায়ে এডব্লিউডি সেচব্যবস্থা গ্রহণের হার খুবই কম। এর অন্যতম কারণ হিসেবে কৃষক পর্যায়ে জরিপ করে জানা যায় যে, দেশে বর্তমান প্রচলিত ক্ষুদ্র সেচব্যবস্থার দুর্বল নীতির কারণেই এডব্লিউডি সেচব্যবস্থা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। কৃষক জানান, যেহেতু শ্যালো টিউবওয়েলের মালিকানা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একক মালিকের অধীনে এবং কৃষকদের পানি সেচের খরচ হিসেবে দেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২৫-৩০ শতাংশ ধান কর্তনের পর জমিতে পানিসেচ বাবদ শ্যালো মালিককে দিতে হয়। যদিও এডব্লিউডি সেচের ফলে পানি কম লাগে, শ্যালো মালিকের জ্বালানি খরচ কমে যায় তবে এতে ধানচাষিরা কোনো উপকার পান না। কারণ শ্যালো মালিক ধানের ভাগের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেন না। ফলে কৃষক পর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং তারা এডব্লিউডি সেচব্যবস্থা গ্রহণ করতে আগ্রহী হন না।

সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ধানের উৎপাদন বাড়ানো, যা বর্তমানের ধান উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রেখে ফলন আরও বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি পূরণ। গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি চালু করার মধ্য দিয়ে ইউরিয়া সারের আমদানি ব্যয় কমানো, ইউরিয়া সারের অপচয় কমানো, হেক্টরপ্রতি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে ন্যূনতম ২৫-৩০ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি করার এ চমৎকার প্রযুক্তির সঙ্গে এডব্লিউডি সেচব্যবস্থার সমন্বয়ে সরকার যেমন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার স্থায়ী কৌশল হিসেবে গ্রহণ করতে পারে; সেইসঙ্গে এই যৌথ প্রযুক্তির সমন্বয়ে দেশের ধানের ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এই যৌথ প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়নের জন্য যে কয়টি বিষয় বিবেচনা করলে সহজেই সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব তা হচ্ছে—

১. অ্যাগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোনভিত্তিক বা ক্লাইমেট হটস্পটভিত্তিক জলবায়ুবান্ধব, বায়োফর্টিফাইড বা বিশেষ পুষ্টিসমৃদ্ধ উচ্চফলনশীল ধানের জাত নির্বাচন।

২. বিসিআইসি ডিলার পর্যায়ে গুটি ইউরিয়া প্রস্তুতকারী ব্রিকোয়েট মেশিন নিশ্চিতকরণ এবং ধান চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার বাধ্যতামূলককরণ ও সহজলভ্যকরণ।

৩. শ্যালো মেশিনের একক মালিকানার পরিবর্তে জমি যার, পানি তার ভিত্তিতে সব কৃষকের মালিকানায় সমবায়ের মাধ্যমে শ্যালো মেশিন পরিচালনা।

৪. বিশেষ প্রণোদনার আওতায় কৃষকের মধ্যে গুটি ইউরিয়া বিতরণ।

৫. শ্যালো মেশিনের স্কিমভিত্তিক সমলয় চাষে একই জাতের ধান চাষে কৃষকদের উৎসাহিতকরণ।

৬. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিটি ব্লক পর্যায়ে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ ও নিয়মিত মনিটরিং।

আগামীতে দেশের কম পরিমাণ জমি থেকে বেশি ফসল ফলাতে হবে অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্যের জোগানের জন্য। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে উন্নত দেশগুলোর বেপরোয়া গতিতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোসহ শিল্পায়নের মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে। এর ফলে দেশের কৃষিতে এরই মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে চিন্তা করতে হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা যায়। যদিও দেশে এই মুহূর্তে যেসব প্রযুক্তি রয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার বা প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে প্রতি বছর ধানের ফলন কমপক্ষে ২৫-৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু পলিসি নির্ধারণের আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং এর অধিদপ্তরগুলোর নিষ্ঠা, সততা, দেশপ্রেম ও আন্তরিকতার।

লেখক: অ্যাগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টিভিতে আজকের খেলা

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে অশালীন মন্তব্য, ছাত্রলীগ কর্মীর চুল কর্তন

০২ জুলাই : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ঢাকায় বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা

বুধবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

০২ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

টিকাটুলিতে ভয়াবহ আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট

বিয়ের প্রলোভনে ‘ধর্ষণ’, পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার

পরীক্ষায় নকল সরবরাহ করতে যান ছাত্রদল নেতা, অতঃপর...

ছাত্রীদের হলে পুরুষ স্টাফ দিয়ে তল্লাশি

১০

দাম কমলো ইন্টারনেটের

১১

ইসরায়েলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

১২

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা উপযোগী, ভাবার অনুরোধ তারেক রহমানের

১৩

বৈষম্যবিরোধী নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ

১৪

জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ

১৫

শাহজালালে বোয়িং বিমানে লাগেজ ট্রলির আঘাত

১৬

আখতারকে রংপুর-৪ আসনে এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা

১৭

মধ্যরাতে বরখাস্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার

১৮

‘একসঙ্গে সমুদ্রে নেমে তো গোসল করতে পারব না’

১৯

জুলাই যোদ্ধার তালিকায় এক ব্যক্তির নাম ২ জায়গায়

২০
X