মহালয়া তিথিটিকে বলা হয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতিপর্ব। শাস্ত্রীয় বিধানমতে, মহালয়ার রয়েছে দুটি পর্ব—একটি পিতৃপক্ষ, অন্যটি দেবীপক্ষ। অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপক্ষের শেষ হয় আর প্রতিপদ তিথিতে শুরু হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের সূচনালগ্নকে মহালয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়। হিন্দুধর্ম যে কোনো শুভ কাজে যেমন বিয়ে, উপনয়ন ইত্যাদিতে কাজের আগে নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ করতে হয়, তেমনি মাতৃ আরাধনার আগে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তিলজল নিবেদন করতে হয়। কেউ মারা গেলেও তার আত্মার মৃত্যু হয় না। আত্মার বিনাশ বা ক্ষয় নেই। পিতৃপুরুষের আত্মার তৃপ্তি সাধনের জন্য মহালয়ার তর্পণ-শ্রাদ্ধ। তর্পণ-শ্রাদ্ধ শেষ করেই দেবীপক্ষের দিকে এগিয়ে যাওয়া। মহালয়া হলো পিতৃপক্ষের শেষ ও দেবীপক্ষের শুরুর সন্ধিক্ষণ।
‘মহালয়া’ কথাটি এসেছে মহালয় থেকে। মহালয়ের অর্থ পরমাত্মা। বৃহৎ আলয়। সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম মহালয়। ব্যাকরণগত দিক মহান আলয় যাতে তা—বহুব্রীহি সমাস। মহালয় + আপ—স্ত্রীলিঙ্গে মহালয়া। অন্যদিকে মহালয়া যেহেতু একটি তিথি, এই তিথি শব্দটি সংস্কৃতে স্ত্রীলিঙ্গ বলেই বিশেষণ হিসেবে শব্দটি হয়েছে মহালয়া। মহালয়া হলো শারদীয়া দুর্গাপূজার পূর্ব অমাবস্যা—অর্থাৎ আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা। (অমাবস্যা—অমা + বস + য, অধিকরণ বা + আপস্ত্রীং। কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথি। এই তিথিতে চন্দ্র অদৃশ্যভাবে উদিত হয় এবং সূর্যের সঙ্গে সমসূত্রভাবে অবস্থিতি করে—সারা রাত অন্ধকার থাকে। ইংরেজিতে বলে ‘Day of the new moon.’)।
স্কন্দপুরাণে মহালয়া শব্দটি পাওয়া যায়। মাহেশ্বর খণ্ডে সমুদ্র মন্থনের কাহিনি রয়েছে। সমুদ্র মন্থনকালে অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে অমৃত কুম্ভ উঠেছিল। দেবতা ও অসুরদের মধ্যে অমৃত নিয়ে বিবাদ হয়। বিবাদ স্থলে দেবতাদের আহ্বানে দেবী মোহিনীর ছদ্মবেশে স্বয়ং বিষ্ণু অবতীর্ণ হন। ছলাকলা করে দেবতাদের অমৃত পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দেবতারা অমৃত পান করে হয়েছিলেন অমর। অমৃত না পেয়ে অসুররা হয়েছিলেন মরণশীল। দেবী মোহিনী হলেন দেবতাদের আশ্রয়স্থল অর্থাৎ মহৎআলয়। দেবী মোহিনীকে দেবতারা মহালয়া তিথিতে আরাধনা করেছিলেন। সেই থেকে দেবী মোহিনী মহালয়া নামে স্বীকৃতি পান। বৈদিক যুগে ১৬ ভাদ্রের অমাবস্যা তিথিতে এক মহালয় অর্থাৎ মহাপ্রলয় হয়েছিল। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে (Swelling of water in the Sea এর ছোট্ট সংস্করণ সুনামি Tsunami–High sea-wave.) সমগ্র পৃথিবীর স্থলভাগ জলের তলায় চলে যায়। পামির মালভূমিসহ কোনো কোনো পার্বত্য অঞ্চল ডুবতে বাকি ছিল। সে সময়কার হিসেবে কোটি কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন ওই জলোচ্ছ্বাসে। বহু জনপদ ধ্বংস হয়েছিল। পার্বত্য এলাকায় যারা জীবিত ছিলেন, তারা জল সরে যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। হাজার হাজার বছর পর হলেও আর্যরা আমাদের ভারতবর্ষে আসেন। তখন ভারতবর্ষে অনার্যরাও ছিলেন। আর্য ঋষিরা বৈদিকযুগে হাজার হাজার বছর আগের ওই ১৬ ভাদ্রের অমাবস্যায় সংঘটিত মহাপ্রলয়ে মৃতদের উপলক্ষ করে মঘা নক্ষত্রে বিষুব মিলনকালীন সূর্যকে ‘পিতৃগণ’ নামে স্তব করেছিলেন। ভাদ্র মাসের অমাবস্যার ১৪ দিন পূর্ব থেকে নানান অর্ঘ্য দিয়ে সূর্যের উপাসনা চালু করেছিলেন। ‘পিতৃগণ’ নামধারী সূর্যই হলেন পূর্বপুরুষ।
শ্রীতপন আচার্য তার ‘মহালয়া’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “কালক্রমে দেবতাদের স্বরূপ অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় ‘পিতৃগণ’ নামধারী সূর্যার্ঘ্য দান রূপান্তরিত পিতৃপুরুষের অর্পণে। দেখা যাচ্ছে, ভাদ্রের অমাবস্যা তিথিটি যে মহালয়া নামে চিহ্নিত হয়েছে, এর উৎস বোধহয় ওই মহা-লয় অর্থাৎ মহাপ্রলয় থেকে। (মহালয় স্ত্রীলিঙ্গে মহালয়া)। আবার তর্পণ-শ্রাদ্ধে দেখা যায়, তর্পণকারী জলে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিক তাকিয়ে তিলজল পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য নিবেদন করছেন। আর্য-ঋষি-নির্দিষ্ট সূর্যই পিতৃগণ তথা পিতৃপুরুষ তথা পূর্বপুরুষ।’
সনাতন ধর্মশাস্ত্র অন্য কথাও বলে, মহালয়া তিথিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন, তাদের প্রতি তর্পণ অর্পণ করেন এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্মানুসারে, এই দিনে মূলত প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠানো হয়। প্রয়াত আত্মার এরূপ সমাবেশকে মহালয় বলা হয়। আর এই মহালয় থেকেই মহালয়ার উদ্ভব।
পুরাণ-কাহিনির আলোকে বলা যায়—সূর্যই আমাদের মহা-আলয়—সমগ্র জীবজগৎ তার মহৎ আলয়ে প্রতিপালিত। ‘পিতৃদেবো ভব, মাতৃদেবো ভব, আচার্য দেবো ভব’—এই আপ্তবাক্যটিকে মূলধন করে দেবতার জ্ঞানে জন্মদাতা পিতা-মাতা, শিক্ষাদাতা শিক্ষককে আশ্রয় করে আমাদের চলমান জীবনচর্যা। আবার দেশবরেণ্য এবং বিশ্বরেণ্য মণীষীরাও একেকজন মহৎ আলয় বা মহালয়। কাজেই মহালয় কথাটি বা শব্দটি এখানে বহুমাত্রিক হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
মহালয়া পক্ষের ১৫টি তিথির নাম আছে। সেগুলোর নাম হলো—প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাকে তার পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মেও একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মেও একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে চলে যান। এই কারণে কেবল জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে।
পিতৃপক্ষে পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশাধিকার পান। এই প্রসঙ্গে গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে, ‘পুত্র বিনা মুক্তি নাই।’ মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে, ‘পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।’
আজ মহালয়া। মহালয়ার দিনে দেব-দেবীকুল দুর্গাপূজার জন্য নিজেদের জাগ্রত করেন। মহালয়া মানেই শারদীয় দুর্গোৎসবের পুণ্যলগ্নেরও শুরু। ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও মূলত আজ থেকেই দুর্গা মায়ের আগমন ধ্বনিতে মুখরিত চারদিক। কথিত আছে, দশমীতে শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। শাস্ত্রমতে, মহালয়ার মাধ্যমে বছর ঘুরে হিমালয়ের কৈলাশ থেকে মা আসেন মর্ত্যলোকে অর্থাৎ বাপের বাড়ি। মায়ের সঙ্গে থাকেন আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবীলক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করে ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। এ যেন একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের এক অপূর্ব সমাবেশ।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ