মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০২:২২ এএম
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫৫ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগস্টে বিশ্বচিত্র

ফরাসি বিপ্লবের রক্তস্নাত দিন

ফরাসি বিপ্লবের রক্তস্নাত দিন

১০ আগস্ট ১৭৯২ সালের বিদ্রোহ ছিল ফরাসি বিপ্লবের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ সময় প্যারিসে সশস্ত্র বিপ্লবীরা ফরাসি রাজতন্ত্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে তুইলেরি প্রাসাদ আক্রমণ করে। সংঘর্ষের ফলে ফ্রান্স রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটায় এবং একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।

ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই এবং দেশটির নতুন বিপ্লবী আইনসভার মধ্যে দ্বন্দ্ব ১৭৯২ সালের বসন্ত ও গ্রীষ্মের দিনগুলোতে ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। কারণ লুই বিধানসভার ভোটে ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের বিপক্ষে ভেটো দেন। আগস্টের শুরুতেই প্যারিসে খবর পৌঁছে যে, রাজপরিবারের মিত্র প্রুশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীর কমান্ডার ব্রান্সউইক ঘোষণা করে, ফ্রান্সের রাজপরিবারের কোনো ক্ষতি হলে সে দেশের জনগণের ক্ষতি করা হবে। ১০ আগস্ট বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে প্যারিস কমিউনের ন্যাশনাল গার্ড এবং পার্শ্ববর্তী মার্সেই ও ব্রিটানির সেনারা প্যারিসের টুইলেরিস প্রাসাদে রাজার বাসভবনে হামলা চালায়। রাজা লুই প্রাসাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সুইস গার্ডদের দ্বারা রাজপ্রাসাদ রক্ষা করেন। যুদ্ধে শত শত সুইসরক্ষী এবং ৪০০ জন বিপ্লবী নিহত হয় বলেও জানা যায়। পরবর্তীকালে রাজা লুই এবং রাজপরিবার আইনসভার কাছে নতিস্বীকার করেন। এর ফলে ছয় সপ্তাহের মধ্যে রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। ২১ সেপ্টেম্বর নতুন জাতীয় কনভেনশনের কার্যক্রম শুরু হয় এবং পরের দিন ফ্রান্স একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ফরাসি বিপ্লবের রক্তস্নাত দিন : ১০ আগস্ট, ১৭৯২, শুক্রবার। সংঘাতের সূত্রপাত ১৭৯২ সালের ২০ এপ্রিল। এদিন ফ্রান্স নতুন করে বোহেমিয়া এবং হাঙ্গেরির (অস্ট্রিয়া) রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রাথমিক যুদ্ধগুলো ফরাসিদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। পাশের দেশ প্রুশিয়াও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সক্রিয় জোটে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যোগ দেয় এবং ১৩ জুন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফ্রান্সের এমন বিপর্যয়ের জন্য রাজা লুই এবং তার মন্ত্রীদের দায়ী করে বিপ্লবী সাধারণ জনগণ। নানাবিধ নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসে আগস্ট। বিভিন্ন বিষয়ে বিপ্লবীদের আইনসভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজা লুই বিধানসভার মাধ্যমে ভেটো দেন। এতে রাজার বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই শুরু করে বিপ্লবীরা।

রাজা দেশের জনপ্রিয় নেতাদের নানাভাবে কিনতে চেয়েও ব্যর্থ হন। বিদ্রোহ দমনের জন্য দেওয়া অর্থ কিংবা প্রতিশ্রুতির কোনোটাই কাজে আসেনি। শেষমুহূর্তে তাকে ক্ষমতা ছাড়ার পরামর্শ দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি তুইলেরিয়াস রাজপ্রাসাদ রক্ষার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তার সমর্থকরা অনেক আগেই বিপ্লবীদের আক্রমণের শঙ্কা করে চলেন এবং এ জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। রাজপ্রাসাদ প্রতিরক্ষার একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল পেশাদার সমরবিদের দ্বারা। প্রাসাদ রক্ষার জন্য প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য জড়ো করা হয়। এর মধ্যে ছিল ৯৫০ জন ভাড়াটিয়া সুইস গার্ড, ৯৩০ জন জেন্ডারমেস, ২০০০ জাতীয় রক্ষী ও ২০০-৩০০ শেভালিয়ার্স। তাদের সঙ্গে আরও ছিল ডি সেন্ট লুই এবং অন্যান্য রাজকীয় স্বেচ্ছাসেবক দল। তবে এ প্রতিরক্ষা তত্ত্বাবধানে দুর্বলতা ছিল এবং সার্বিকভাবে গোলাবারুদের স্বল্পতা ছিল।

বিপ্লবীরা শুরুতেই রাজপ্রাসাদ আক্রমণ না করার ঘোষণা দেয় এবং রাজা লুইকে আত্মসমর্পণপূর্বক আইনসভার হেফাজতে থাকার প্রস্তাব দেয়। রাজার প্রতিরক্ষা বাহিনীর সেনা কমান্ডারসহ অনেকেই এ সময় আত্মসমর্পণ করে, আবার কেউ কেউ মারা যায়। ১০ আগস্ট সকাল ৭টার দিকে মূলত প্রাসাদরক্ষীদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বড় মাপের কোনো সেনানায়ক উপস্থিত ছিল না। রাজা লুই বিছানা ছেড়ে রাজকীয় পোশাক পরিধান করে ও যথারীতি কোমরে তরবারি ঝুলিয়ে প্রাসাদ ভ্রমণে বের হন। এ সময় তাকে সুপ্রভাত জানানো এক রক্ষীর সঙ্গে ঝগড়া বাধে অন্যদের। রাজা বিপদ টের পেয়ে দ্রুত প্রাসাদে ফিরে যান। এর মধ্যে রাজপ্রাসাদের রক্ষীরা পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও রক্তপাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং ভাইয়ের বিরুদ্ধে গুলি না করার এবং কামান না দাগানোর ঘোষণা দেয়। এ অবস্থায় রানি অস্ট্রিয়ান সুন্দরী মেরি এন্টিনেটা যে কোনো মূল্যে প্রাসাদে থাকার এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু রাজা ছিলেন নিরুপায়। তিনি আইনসভায় আশ্রয় নেন এবং অপমান সহ্য করে বিপ্লবী নেতাদের তথা মন্ত্রিসভার পেছনে আসন গ্রহণ করেন। রাজা লুই রাজপ্রাসাদ ছাড়ার পর প্রাসাদরক্ষীরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তবে ব্যতিক্রম ছিল সুইস রক্ষীরা। তারা রাজার আদেশ ছাড়া রাজপ্রাসাদ ত্যাগ না করার শপথ নিয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এরপর জনতা সাধারণ দেশীয় অস্ত্র এবং বিপ্লবীরা ভারী অস্ত্র নিয়ে প্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করে। সুইসরক্ষীদের দৃঢ়তায় ঘণ্টাখানেক থমথমে অবস্থা বজায় থাকলেও একপর্যায়ে লড়াই শুরু হয় এবং উভয়পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে। এমন যুদ্ধ চলাকালে সুইসরক্ষীরা একটি কাগজ হাতে পায়, যেখানে রাজা লুই কর্তৃক সুইসদের অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ ছিল। এ নির্দেশ পেয়ে সুইস সেনারা প্রাসাদের পেছনে এক পুকুরপাড়ে আশ্রয় নেয়। উন্মত্ত জনতা তাদের ওপর চড়াও হয় ও ঘটনাস্থলে ৯০০ জনের মধ্যে প্রায় ৬০০ জনকে জবাই করে হত্যা করে। কেউ আইনসভায় আবার কেউ এদিক-ওদিক পালিয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা করে। অন্য তথ্যমতে, ৩০০ জন সুইসরক্ষীকে বন্দি করে জেলে রাখা হলেও পরের মাসে (সেপ্টেম্বরে) আরেকটি আক্রমণে তাদের ২০০ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রাজার পক্ষের ৮০০ এবং বিপ্লবীদের পক্ষে ৩০০ জনের প্রাণনাশ হয় বলে অধিকাংশের ধারণা। সেই সঙ্গে উভয়পক্ষে শত শত মানুষ আহত হয়।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন / লন্ডনে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের ১৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ

সন্ধ্যায় বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে বসবেন প্রধান উপদেষ্টা

প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় নেই ডাম্পিং স্টেশন

ঈদে হাট কাঁপাতে আসছে ‘লালু সর্দার’ ও ‘কালিয়া’

ছুটির দিনে ঘুরতে গিয়ে খুন হলেন আব্দুল্লাহ

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যুবকের মৃত্যু, পরিবারের দাবি হত্যা

চরে হঠাৎ জোয়ারের পানি, মৃত অবস্থায় ৩৪ গরু উদ্ধার

মার্কিন মালিকানায় গেল দ্য টেলিগ্রাফ

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১১ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

আজ কেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

১০

ঈদুল আজহা : ট্রেনের ৩ জুনের টিকিট বিক্রি আজ

১১

গাজার উত্তরে এখনো খাবার যায়নি, আরও মৃত্যু ৭৬

১২

২৪ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

২৪ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রতারণার ফাঁদ, অতঃপর

১৫

‘যারা আজ সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত, তারাই মাকে দূরে রাখতে চায়’

১৬

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতার পদত্যাগ

১৭

চবি তেপান্তর সাহিত্য সভার নেতৃত্বে আবদুল মোমেন-রিয়াদ উদ্দিন

১৮

বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়কদের দুগ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৪

১৯

সৈকতে পড়ে আছে মৃত ডলফিন, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

২০
X