পৃথিবীর অনেক দেশেরই বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম পর্যটন শিল্প। এটি এখন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। কেননা একই সঙ্গে পৃথিবীতে যেমন পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি এর ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নও সাধিত হচ্ছে। এর ফলে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা যেখানে ছিল ২৫ মিলিয়ন, তা ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৬ লাখ ৬০ হাজারে। আর ২০১৭ সালেই জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ১০.৪ ভাগ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই এমন অবদান দেখানো যাবে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা। পর্যটকদের সংখ্যাও অনেক ছিল। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ। আর দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা যোগ করলে এর সংখ্যা প্রায় চার কোটির কাছাকাছি চলে যাবে। এর ফলে এ খাতে বিনিয়োগ সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে অনেক। ২০১৭ সালের হিসাবমতে, পর্যটন খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার আর বিনিয়োগ হয়েছে ৪৩ বিলিয়ন টাকা। ২০২৩ সালে এ পর্যটনের সংখ্যা বাংলাদেশে বেড়েছে অনেক। বিদেশি পর্যটক হয়েছে ২০২৩ সালে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। এর আগের পরিসংখ্যানগুলো দেখলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছেই। ২০১৮ সালে এর সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০, ২০১৯ সালে এর সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১, ২০২০ সালে ছিল ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮, ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন। বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্যুরিস্ট অর্গানাইজেশনের মতে, সারা বিশ্বে ১৯৯১ সালে বিভিন্ন জায়গায় পর্যটন করেছে ৪৪৮.৫ মিলিয়ন পর্যটক। এ পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে ৪.৬ শতাংশ অর্থাৎ ৫৯৩ মিলিয়ন হয়েছে ১৯৯৬ সালে। ২০০৪ সালে ৭৬৩ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক পর্যটক পর্যটন করেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ১০.৫৮ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ নানা কারণে পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠছে। এখানে যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র নানান বন, ইকোপার্ক, পাহাড়, সমুদ্রসৈকত, হাওর ইত্যাদি। ইকোপার্কগুলো বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্র। ইকোপার্ক শব্দটি এসেছে ইকোলজিক্যাল পার্ক শব্দ থেকে। এ পার্কের মূল উদ্দেশ্য প্রকৃতিকে ক্ষতি না করে দর্শনার্থীদের বিমোহিত করা। বিনোদনের উদ্দেশ্যে মানুষ ভ্রমণ করলেও কিছু বিধিনিষেধ তাকে মেনে চলতে হবে। এর ফলে মানুষ প্রকৃতি, প্রকৃতি সংরক্ষণ নিয়ে আগ্রহী হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে। ইকোপার্কে ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ নানা ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে ধারণা নিতে পারবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকরা এখানে গবেষণা করতে পারবেন। একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও সংরক্ষিত থাকবে।
বাংলাদেশের বনভোজন বিষয়টি এসেছে ফরাসি পিকনিক শব্দ থেকে। ফ্রান্সে কিছু ব্যক্তি বাসা থেকে খাবার নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতেন। এখান থেকেই পিকনিকের বিষয়টি এসেছে। পরে বনভোজনের উদ্দেশ্য হয় প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে ভালো কিছু খাওয়া। প্রতি বছর বছরের শুরুতে এবং শীতকাল এলেই বনভোজন শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানা জায়গায় বনভোজনে যায়।
কিন্তু এসব পর্যটন ও বনভোজনের কারণে পরিবেশগত নানা বিপর্যয়ও হচ্ছে। একদিকে নানা দেশ-বিদেশ থেকে লোকজন আসাতে অর্থ উপার্জন যেমন বাড়ছে, তেমনি নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। পর্যটকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিতে গিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। মানুষের আনাগোনা বাড়াতে পশুপাখিরা চলে যাচ্ছে। এদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। মানুষ-বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব বেড়ে যাচ্ছে। যানবাহনের কারণে বায়ু ও শব্দদূষণ হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহারের কারণে ইকোপার্কের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক আবাসভূমির ক্ষতি হচ্ছে। বিপদসংকুল প্রজাতির ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন হোটেল-রিসোর্ট নির্মাণ হচ্ছে, অন্যদিকে মাটির ক্ষয় হচ্ছে, পাহাড় কাটা হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত পর্যটনের কারণে ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে ইকোপার্ক হারাতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের ইকোপার্কও হয়তো হারিয়ে যাবে।
সম্প্রতি পরিবেশ উপদেষ্টা এক সভায় বলেন, লাঠিটিলা, চুনতি, সাতছড়ি, লাউয়াছড়ায় ইকোট্যুরিজম ও পিকনিক বন্ধ করতে হবে। তিনি সেখানে গান-বাজনাও বন্ধ করতে বলেন। সেখানকার ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কমিটিও গঠন করতে বলেন। ২০২২ সালে ভারতের হুগলি জেলার চাঁদুর ফরেস্টে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। তবে সেখানে বনভোজন নিষিদ্ধ করা হয় না। এর বদলে উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজানো, ডিজে বাজানো নিষিদ্ধ করে। প্রাকৃতিক পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য কড়া নজরদারির মাধ্যমে বনভোজন করার অনুমতি দেওয়া হয়। এর ফলে এখানে একটা পরিবর্তন দেখা যায়। সেটা হলো উচ্চশব্দের কারণে সেখানকার পাখিরা চলে যেত। এগুলো বন্ধ থাকার কারণে পাখিরা আর অন্য কোথাও যায়নি। আর শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে পিকনিক বা বনভোজন করার আরেকটা নির্মল আনন্দ আছে; এটা অনেকেই বুঝতে পারে। বাংলাদেশ এমন উদ্যোগ নিতে পারে। এতে করে পর্যটন খাত যেমন ক্ষতির মুখে পড়বে না, তেমনি ইকোপার্কও ধ্বংসের মুখে পড়বে না। বাংলাদেশে নয়টি ইকোপার্ক রয়েছে। এসবের মধ্যে সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক, বাঁশখালী ইকোপার্ক, মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক অন্যতম। বাংলাদেশের কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটকের সংখ্যা ২০২৩ সালে সর্বাধিক ছিল। ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করার মাধ্যমে এসব ইকোপার্ক ও অঞ্চলে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক