পাকিস্তানের ২৪ বছরে বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক নেতাদের অসততার কারণে বর্তমান বাংলাদেশের জনগণকে বিভিন্ন সময়ে প্রতারণার শিকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছিল। বাংলাদেশ তখন ছিল পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রদেশ হলেও এ দেশেরই কোনো কোনো নেতার ষড়যন্ত্র ও নেতিবাচক ভূমিকার কারণে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। একই কারণে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসেও নস্যাৎ হয়ে গেছে গণতান্ত্রিক আন্দোলন।
উদাহরণ দেওয়ার জন্য ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানকে পর্যালোচনায় নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে এই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং ‘লৌহমানব’ হিসেবে পরিচিত ও এক দশকের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন ছিল সে গণঅভ্যুত্থানের প্রধান অর্জন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসনের অবৈধ পথে ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিভিন্ন নীতি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আইয়ুব খান পাকিস্তানে তার স্বৈরশাসনকে সর্বব্যাপী করে তুলেছিলেন। রাজনৈতিক দমন ও নিপীড়ন চালানোর পাশাপাশি ১৯৬২ সালে তিনি এমন এক শাসনতন্ত্র বা সংবিধান চাপিয়ে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারও স্বীকৃত হয়নি। ওই সংবিধানে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের ওপর সংখ্যাসাম্যের বিধান চাপানো হয়েছিল। সে বিধান অনুযায়ী সাধারণ ভোটারদের ভোটে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার করে ৮০ হাজার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ বা বেসিক ডেমোক্র্যাট নির্বাচিত হতেন। তাদের বলা হতো ‘বিডি মেম্বার’। বিডি মেম্বাররাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে এবং প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য তথা এমপিএ ও এমএনএদের নির্বাচিত করতেন। টাকা ও সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে বিডি মেম্বারদের ভোট সহজে কেনা যেত বলে কোনো নির্বাচনেই জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটতে পারত না। বিডি মেম্বারদের চিহ্নিত করা হতো আইয়ুব খানের ‘দালাল’ হিসেবে। অনুচর ও দালাল তৈরির পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণ ও জাতিগত নিপীড়ন চালানোর ব্যাপারেও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
এই বৈষম্য, দুর্দশা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছিল প্রদেশের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ। ১৯৬০ সালে শুরু হওয়া সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের ধারায় ১৯৬২-এর সেপ্টেম্বরে শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের পর উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিনগুলোতে অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রধান বিষয়ে পরিণত করে শেখ মুজিব তার ৬ দফা উত্থাপন করেছিলেন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬)। নতুন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হলেও ৬ দফা প্রণীত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার (১৯৫৪) ১৯তম দফার ভিত্তিতে। ফলে কর্মসূচি হিসেবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপনের এ পদক্ষেপের মধ্যে নতুন বা বৈচিত্র্যের কোনো উপাদান ছিল না। কিন্তু এমন এক সময়ে ৬ দফা উপস্থাপিত হয়েছিল, যখন যুদ্ধে পরাজয় এবং তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ভারতের হাতে ‘জাতীয় স্বার্থ ও সম্মান’ তুলে দেওয়ার অভিযোগে আইয়ুববিরোধী জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ দফাকে আইয়ুব খান আত্মরক্ষার অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। পরিণামে শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেপ্তার বরণ করতে হয়েছিল। গ্রেপ্তার, জামিন এবং আবারও গ্রেপ্তারের ধারায় শেষ পর্যন্ত তিনি প্রতিরক্ষা আইনের অধীনে দীর্ঘকালের জন্য বন্দি হয়ে পড়েছিলেন (৯ মে, ১৯৬৬)। আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য অন্য নেতাদেরও আটক করা হয়েছিল। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ঢাকায় পালিত আংশিক সফল হরতালের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।
৬ দফা আন্দোলনের এ ব্যর্থতা নানা দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছিল। ৬ দফার প্রশ্নে ‘পিডিএমপন্থি’ এবং ‘৬ দফাপন্থি’ নাম নিয়ে দুটি আওয়ামী লীগ তৎপরতা চালাতে শুরু করেছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপেও ভাঙন ঘটেছিল ৬ দফার প্রশ্নে। ন্যাপ ৬ দফা সমর্থন করেনি; বরং আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ১৪ দফা হাজির করেছিল (৪-৭ জুন, ১৯৬৬)। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের খান আবদুল ওয়ালী খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে দলে ভাঙন ঘটিয়ে গঠন করা হয়েছিল ‘মস্কোপন্থি’ ন্যাপ (১৬-১৭ ডিসেম্বর, ১৯৬৭)। ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তানি নেতারা আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে ‘জাতির মুক্তি সনদ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই ভাঙন এবং দুর্বলতার পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নকে দৃঢ়তর করার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক নেতাদের ওপরও বেশি নির্যাতন চালাতে শুরু করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র প্রধান আসামি করা হয়েছিল (১৮ জানুয়ারি ১৯৬৮)। কিন্তু সে পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগ কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। অনেকটা গোপনে অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে অভিযুক্ত শেখ মুজিবকে ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানপূর্বক প্রকাশ্যে বিচার অনুষ্ঠানের’ জন্য সরকারের প্রতি দাবি নয়, ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল (২১ জানুয়ারি, ১৯৬৮)। আওয়ামী লীগ তখন ষড়যন্ত্র মামলাটিকে মিথ্যা বা সাজানো মামলা হিসেবে অভিহিত করার মতো অবস্থায়ও ছিল না। ১৯৬৮ সালজুড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলেছে, শুনানির বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই, যার ভিত্তিতে বলা যাবে, ‘৬ দফাপন্থি’ আওয়ামী লীগ মামলাটির বিরুদ্ধে কোনো মিছিল বা সমাবেশ করেছিল। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা এমনকি দলের অফিসে যাতায়াতও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখানে কৌতূহলোদ্দীপক অন্য একটি তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থি’ আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি বা আইনজীবী হিসেবে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন।
৬ দফাপন্থি আওয়ামী লীগের শুধু নয়, সব মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থাও সে সময় শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। প্রতিবাদহীন রাজনৈতিক স্থবিরতার সেই দিনগুলোতে আইয়ুববিরোধী সফল আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে বিভিন্ন ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান স্বায়ত্তশাসনের দাবির জবাবে ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি উচ্চারণ করেছিলেন। ৫ ডিসেম্বর ঢাকার ‘রমনা গ্রিন’-এর সমাবেশে আইয়ুব খান চ্যালেঞ্জের সুরে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, আন্দোলন বা বিক্ষোভের পথে তাকে বা তার সরকারকে টলানো যাবে না। আইয়ুব খানের এসব উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে ‘জুলম প্রতিরোধ দিবস’ পালন শেষে ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত বিশাল জনসভা থেকে মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন (৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৯)। (নিবন্ধটির বাকি অংশ প্রকাশ হবে আগামীকাল)
লেখক: সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক