পলিথিন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি প্রয়োজনীয় অংশ। নিত্যদিনের অংশ হলেও এটি পরিবেশের বড় শত্রু। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। দেশেও বারবার পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, এটিই বড় প্রশ্ন?
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তারপরও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। সাম্প্রতিককালে রাজধানীর পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন শপিং ব্যাগমুক্ত বাজারকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, ‘পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, পরিবহন, বিপণন ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’। কিন্তু সেই ঘোষণায় কতটুকু কমেছে পলিথিনের ব্যবহার? আবার বিকল্প উৎপাদন বেড়েছে কি না, সেটিই ভাবার বিষয়। মাঠপর্যায়ে এখনো দেখা মেলে সর্বত্র পলিথিনের ব্যবহার। গার্মেন্টস বা পোশাক দোকানে টিস্যু ব্যাগের ব্যবহার বাড়লেও কাপড়গুলো মোড়ানো থাকে পলিথিনের আবরণে।
পলিথিন প্রতিনিয়ত পরিবেশ নষ্ট করছে। শুধু কি মাটিদূষণ? না, পানি ও বায়ুদূষণসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। কারণ, পলিথিন একটি প্লাস্টিক পণ্য। এটি পরিবেশে পচে বা গলে না। এটি মাটিতে বা পানিতে পড়ে থাকে, যার ফলে পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটি মাটির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে। এতে কৃষিকাজে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানগুলো মাটির প্রাকৃতিক গঠন পরিবর্তন করে। এর ফলে কৃষিজমিতে ফলন কমে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় পলিথিন নদী, খাল-বিল, সাগর এবং অন্যান্য জলাশয়ে জলজ প্রাণীর জন্য খুব বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এ কারণে সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুহার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এমনকি ইকোসিস্টেমেরও ভারসাম্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে।
পলিথিনের কারণে যে শুধু মাটি ও পানিই দূষিত হচ্ছে তা নয়, বায়ুদূষণের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে এটি। অনেক সময় দেখা যায়, রাস্তার আশপাশে পড়ে থাকা পলিথিন বা গৃহস্থালির রান্নার কাজে অব্যবহৃত পলিথিনগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। এর ফলে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ুদূষণ ঘটায়। আবার কিছু জায়গায় দেখা যায়, পলিথিনের খোলসগুলো খোলা অবস্থায় পড়ে থাকে, যে কারণে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। অনেক অসচেতন মানুষ এটি যত্রতত্র ফেলে রাখেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা টিফিনে বিস্কুট, চানাচুর, বাদাম, চিপস, কেক ইত্যাদি খেয়ে থাকে। সেগুলোর খোলস ফেলে দেয় জানালা দিয়ে অথবা ঝুড়িতে। গ্রামগঞ্জে সেগুলো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করা হয় না। হয়তো কোনো গর্তে ফেলে দেওয়া হয় অথবা পুড়ে ফেলা হয়। ফলে বায়ুদূষণসহ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এতে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যহানিও ঘটে।
তাই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের আগে দরকার বিকল্প পদ্ধতি প্রস্তুত করা। এটির ব্যবহার রোধে শুধু আইনই যথেষ্ট নয়, এর জন্য সামাজিক সচেতনতা এবং জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণও প্রয়োজন। পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে কাগজের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, জুট বা থ্রেড ব্যাগ অথবা বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগের ব্যবহার দ্রুত বাড়াতে হবে। কারণ এ ব্যাগগুলো পচনশীল, যা প্রকৃতিতে সহজেই মিশে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ দূষণ থেকেও বাঁচায়। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের পরিবর্তে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য, ই-কমার্স বা ছোট ছোট ব্যবসায় যাদের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার একটি প্রচলিত অভ্যাস হয়ে গেছে, তাদের বিকল্প প্যাকেজিং ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এমনকি পলিথিন ব্যাগ সংগ্রহ করার জন্য উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও গড়ে তুলতে হবে। স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও বণিক সমিতিতে পলিথিনের ক্ষতিকর দিক এবং পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষামূলক সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। যাতে পলিথিনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অবগত হয়। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি মনে করছি। তবেই একটি নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে।
জি.বি.এম রুবেল আহম্মেদ
সংস্কৃতিকর্মী, মাদারগঞ্জ, জামালপুর