রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনা যেন এক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো একটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটলে প্রথমে কিছুদিন তা নিয়ে আলোচনা হয়, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চলে, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তারপর ধীরে ধীরে সব মুখর থেমে যায়। তদন্তে কী সুপারিশ আসে, তা জনগণের অজানা থেকে যায়। অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সচরাচর শোনা যায় না। অগ্নিদুর্ঘটনাও আর থেমে থাকে না। বিগত দিনে হোটেল-রেস্তোরাঁয়, গার্মেন্টস কারখানায়, রাসায়নিক গুদামে বেশ কয়েকবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের বৃহৎ ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় মজুতকৃত রাসায়নিক পদার্থের বিস্ফোরণে আগুন লেগে পুড়ে অঙ্গার হলো ৭৯টি তরতাজা প্রাণ। গুরুতর আহত হয় ৪১ জন। সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া ৫টি ভবনের একটি ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টে ছিল ড্রাম ও বস্তাভর্তি ১১ ধরনের কেমিক্যালের মজুত। ২০১০ সালের ৩ জুন ৩০ লাখের অধিক মানুষের বসতবাড়ি নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নেয় ১২৫ জন মানুষের প্রাণ। একসময় গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। একের পর এক গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অসংখ্য শ্রমিকের মৃত্যুর পর শ্রমিকের নিরাপত্তার ব্যাপারটি উপেক্ষিত থাকার কারণে গার্মেন্টস রপ্তানিতে ধস নামতে শুরু করলে শিল্পমালিকরা অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় হ্রাস পায় গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
এবার আর কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁ, রাসায়নিক গুদাম বা গার্মেন্টস কারখানায় নয়, ২৫ তারিখ রাত ২টায় রাজধানীর কেন্দ্রে খোদ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ৬ থেকে ৯ তলার চারটি ফ্লোরে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার প্রাণপণ চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও প্রায় ১০ ঘণ্টা আগুন নির্বাপণ সম্ভব হতে ভবনে অবস্থিত ছয়টি মন্ত্রণালয়ের ফাইলপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অগ্নিনির্বাপণের সময় কর্মরত অবস্থায় ট্রাকচাপা পড়ে মারা যান ফায়ার ফাইটার নয়ন। রাজধানীতে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবনে এমন অগ্নিকাণ্ডে প্রশাসন তথা জনমনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। উঁকি দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। এ অগ্নিকাণ্ড কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ। আর কেনই বারবার ঘটছে এমন অগ্নিদুর্ঘটনা। এই তো মাত্র কদিন আগে একটি রেস্তোরাঁর অগ্নিকাণ্ডে এত প্রাণহানির মাত্র দশ মাসের মাথায় আবার ঘটে গেল আরেকটি রেস্তোরাঁয় আগুন লাগার ঘটনা। মাত্র দশ মাস আগে এই বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় পৌনে ১০টায় বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডে কেড়ে নিয়েছিল ৪৬ জন মানুষের প্রাণ। অগ্নিদগ্ধ ২২ জনকে পাঠাতে হয়েছিল হাসপাতালে আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৭৭ জনকে। সেদিনের দুর্ঘটনার শিকার সাততলা ভবনে ছিল বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ। ভবনের নিচ থেকে ওপরের সবই বাণিজ্যিক দোকান, নানা রকম পণ্যে ঠাসা। সম্ভবত সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে ভবনের নিচতলা থেকে স্বাভাবিকক্রমে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ওপরে। ভবনে কোনো ফায়ার এক্সিট ছিল না। একটিমাত্র সিঁড়ি ও দুটি লিফট থাকায় অনেক মানুষ তাড়াহুড়া করে নিচে নামতে ব্যর্থ হয়। প্রচণ্ড ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ভবনে শ্বাসরোধে করুণ মৃত্যু হয়েছে অনেকের। একইভাবে গত ২০ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত লাভলীন রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে। বহুতল আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁটিতে ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ছিল না। এমনকি ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হলেও কর্ণপাত করেনি রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। রাজধানীতে এমনিভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কেমিক্যাল গুদামে, গার্মেন্ট কারখানায়, বড় বড় শপিং-কমপ্লেক্স, সাধারণ মার্কেট, ফ্ল্যাট-বাড়ি এমনকি বস্তিতে। তথ্যসূত্র মতে, দেশে ৫ লাখের মতো রেস্তোরাঁ থাকলেও তারকাচিহ্নিত হোটেল ছাড়া দেশে কতগুলো রেস্তোরাঁ রয়েছে, তার প্রকৃত হিসেব নেই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ নিয়ে কখনো কোনো সমীক্ষা বা জরিপও হয়নি। দেশের মোট ৫ লাখ রেস্তোরাঁর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ২৫ হাজার। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ৫ হাজার রেস্তোরাঁ ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অনুমোদন গ্রহণ করেছে। আর ৭ হাজার রেস্তোরাঁ দুই সিটি করপোরেশন থেকে লাইসেন্স নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা সব রেস্তোরাঁই অনুমোদনহীন বলে জানাচ্ছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। একটি রেস্তোরাঁ চালু করতে হলে সরকারি অন্তত ১২টি সংস্থা বা দপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ দু-তিনটি সংস্থার অনুমোদন নিয়েই কারখানা চালু করে দেয়। অথচ এ ধারাকে প্রতিহত করতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে ওঠা বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ, অফিস, গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা, মার্কেট ও শপিংমলের বৈধ অনুমোদন নেই। এ ছাড়া বেশিরভাগ বহুতল আবাসিক ভবন, বিপণিকেন্দ্র, কলকারখানায় নেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও সীমিত সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলেও এর সঠিক ব্যবহার অনেকের জানা নেই। রাজধানীর বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। বহুতল ভবন বা ভবনের ছাদে রেস্তোরাঁ গড়ে উঠলেও নানা সরঞ্জাম দিয়ে বন্ধ করে রাখা ভবনে মাত্র একটি সরু সিঁড়ি থাকে। অধিক সাজসজ্জা এবং গ্যাস সিলিন্ডার রেখে, আর নিয়মনীতি না মেনে রান্নাঘর তৈরি করায় রেস্তোরাঁগুলো যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। এসবের দেখভাল করার জন্য নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কাজে যেমন রয়েছে শৈথিল্য, তেমনি রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। আবার রয়েছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।
অবৈধ রেস্তোরাঁ বন্ধ না করে বৈধভাবে চালু রাখতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল, তা ছাড়া আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিও একটি সুপারিশমালা তৈরি করে দিয়েছে বলে জানা যায়। তাতে অনুমোদন দেওয়া সব সংস্থা নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি বা তদারকি কমিটি করতে বলা বলা হয়েছিল; কিন্তু ১০ মাসেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালু করতে যেসব সংস্থার অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয়, তা অনেক সময়সাপেক্ষ ও কখনো কষ্টসাধ্য বলে রেস্তোরাঁ মালিকরা অনুমোদন নিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। তাই এ পদ্ধতিকে সহজ করার কথা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। তবে কেউ রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গ করে, সরকারের নিয়মনীতি না মেনে ব্যবসা করতে গিয়ে মানুষের মৃত্যুর কারণ হলে তাকে অবশ্যই আইনানুগ শাস্তি পেতে হবে।
সচিবালয়ে ঘটা অগ্নিকাণ্ডের ভেতরে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতা এবং সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ অগ্নিকাণ্ডকে দুর্ঘটনার বদলে নাশকতা বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে বরাবরের মতো উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। জনগণ আশা করে, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ উদ্ঘাটিত হবে। যে কোনো অগ্নিকাণ্ড যদি হয় দুর্ঘটনাজনিত, তবে তার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার বিহিত করতে হবে। আর আগুন লাগার পেছনে কোনো নাশকতার মতো ন্যক্কারজনক কারণ থাকলে হোতাদের খুঁজে বের করে দিতে হবে উপযুক্ত শাস্তি। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী