ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চশিক্ষার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রমে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে ছাত্র সংসদ বা ‘ডাকসু’। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এই ছাত্র সংসদ জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন।
কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর আলো নিভে যায়। যেন ১৯৯০ সালের পর গত ২৯ বছর পর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। এরপর কেটে গেছে আরও পাঁচটি বছর। হঠাৎ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। ছাত্রনেতারা পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হঠাৎ করেই ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনের দাবি ওঠে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া এলাকা থেকে মিছিল বের হয়। বৃহস্পতিবার রাতের উত্তেজনা শেষে শুক্রবার ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে আলটিমেটাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেয় শিক্ষার্থীদের একটি দল। শিক্ষার্থীদের দাবি, এই রোডম্যাপের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের সময় নির্দিষ্ট করতে হবে। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হয়, তাহলে তারা কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। এর ফলে উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতির দায়ভার প্রশাসনকে নিতে হবে। স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীরা বলেন, স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন তারা দেখছেন, তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে—এমনটাই তাদের প্রত্যাশা। বর্তমান পরিস্থিতি জানিয়ে স্মারকলিপিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে ডাকসু ফের সক্রিয় করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হলেও তার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গঠনতন্ত্র সংশোধনের যে প্রস্তাবনা দিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা বা অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে তাদের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা বরাবরই জাতীয় নেতৃত্বে পথ প্রদর্শক, এই প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে রয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানানো হয় স্মারকলিপিতে।
১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছর পরই যাত্রা শুরু করে ডাকসু। প্রথমে পরোক্ষ ভোটাভুটি, পরে প্রত্যক্ষ ভোটেই প্রতিনিধি নির্বাচন হতো। প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৫৩ সালে। এভাবে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমল পার করল ডাকসু। ডাকসুর প্রথম ভিপি হন এসএ বারি ও সাধারণ সম্পাদক জুলমত আলী খান।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীন বাংলার পতাকাটি প্রথম উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। তখন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন। এ রকম আরও অসংখ্য নেতৃত্ব রয়েছে, যাদের নাম বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস ও রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসুর ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান।
আমরা মনে করি, ডাকসু নির্বাচন না হলে শুধু ছাত্ররাই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না, বাংলাদেশও বঞ্চিত হয়েছে অনেক যোগ্য নেতৃত্ব থেকে। তাই শুধু ডাকসু নয়, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত।