পূর্ব পাকিস্তান, ব্রিটিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেরা প্রকৌশলী দলের তত্ত্বাবধানে এবং পাশাপাশি তিনটি আলাদা স্থাপনা একসঙ্গে করে তৈরি করা ৭ নম্বর ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১২০ মিটার লম্বা। মাঝখানে প্রায় ১০ ফুট চওড়া করিডোরের দুই পাশে সারি সারি অফিস কক্ষ সাজানো রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের জানালা যথেষ্ট বড় এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে একটা করে সিঁড়ি রয়েছে। এই সিঁড়ি দুটো মূলত জরুরি বহির্গমনের জন্য তৈরি করা। আশির দশকে তৈরি করা পাঁচতলা আবাসিক ভবনের মূল সিঁড়িও এতটা স্পেস নিয়ে করা হয়নি। ঠিক মাঝখানে একটা চওড়া সিঁড়ি রয়েছে, যার মাঝখানে দুটো লিফট রয়েছে। প্রশস্ত সিঁড়িটি দুটো লিফট ঘিরে ছাদ পর্যন্ত চলে গেছে। মূলত মাঝখানের এ সিঁড়িটিই হচ্ছে ভবনের প্রধান সিঁড়ি। সচিবালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে যে ভবনটি চোখে পড়বে এটিই সেই ৭ নম্বর ভবন। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগ, গণপূর্তের কিছু রক্ষণাবেক্ষণ কক্ষ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবহন বা কল্যাণ শাখার কিছু অফিস রয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অফিস রয়েছে। এর বাইরে বিদ্যুৎ বিভাগসহ অন্য দুয়েকটি মন্ত্রণালয়ের গুটিকয়েক কক্ষ রয়েছে।
ভবনের করিডোরে সাইডওয়াল এবং সিলিংয়ে এমনভাবে ডেকোরেশন করা হয়েছে যে, সিলিং ও ছাদের মাঝখানে একটা ফাঁকা স্থান তৈরি হয়েছে, যা অনেকটা আয়তাকার পাইপের মতো। আর এ সিলিন্ডারের ভেতরে অগোছালো ও অপরিকল্পিতভাবে রয়েছে যতরকম কেবল ও পাইপ। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও ঠিক এমন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বুয়েটের টিম বলছে, টানেলসদৃশ করিডোরের ফলস সিলিং দাহ্য ও অতিদাহ্য পদার্থ দিয়ে আচ্ছাদিত থাকায় আগুন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের লিফট ও সিঁড়ির অপরিকল্পিত নকশার কারণে চিমনি অ্যাফেক্ট সৃষ্টি হয়, যাতে আগুনের শিখা দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী প্রপাগেশন করে ছয় থেকে সাত, আট ও নয়তলায় ছড়িয়ে যায়, যা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় ৭৫ বছর আগে তৎকালীন সেরা প্রকৌশলীদের নকশায় করা এ ভবন এবং বর্তমান আধুনিক যুগের নকশায় করা নগর ভবনের কক্ষ বিন্যাস এবং সিঁড়ির অবস্থান ঠিক একই আদলে করা। তাহলে বুয়েট সিঁড়ির অপরিকল্পিত নকশার যে কথা বলছে, সেটা সঠিক নাকি বিভিন্ন অজুহাতে ডেকোরেশন বা রিনোভেশনের নামে মূল নকশা বদলে ফেলা হয়েছে? করিডোরে প্রশস্ততা কমিয়ে ফেলা হয়েছে? সিঁড়ির মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় লিফট সংযুক্ত করে চিমনি অ্যাফেক্ট তৈরি করা হয়েছে? সিঁড়িতে অব্যবহৃত ফার্নিচার ও ফুলের টব রেখে সিঁড়িকে ব্যবহার অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে?
অফিসের বড় কর্তাদের কক্ষ এবং বাইরের করিডোর এমনভাবে ডেকোরেশন করা হয়েছে যে, সন্ধ্যার পর কোনো কোনো ফ্লোরের করিডোরে লাইটিং দেখলে আপনার মনে হবে ফাইভ স্টার হোটেলের লবিতে চলে এসেছি। ওপরে-নিচে ডানে-বাঁয়ে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এই ডেকোরেশন করা হয়নি। অফিস ডেকোরেশনের এই নগ্ন প্রতিযোগিতা দেশজুড়ে আগেও চলেছে, এখনো চলছে। এমনকি জেলা-উপজেলা বা পৌরসভা পর্যায়েও একজন নতুন কর্মকর্তা আসলেন তো তার রুমটা নতুন করে ডেকোরেশন করতে হবে। পূর্ববর্তী কর্মকর্তা যে ডেকোরেশন করেছিলেন, সেখান থেকে নতুনের গন্ধ শুকানোর আগেই আবার নতুন কর্মকর্তার পদায়ন হলে তার পছন্দসই ডেকোরেশন করাবেন। এতে করে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আদায় হওয়া রাজস্ব অপচয়ের একটা অভ্যাস রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এই সচিবালয়ে কর্মকর্তা ছাড়া শাখা পর্যায়ের চার থেকে পাঁচজন কর্মচারী একসঙ্গে ১২০-১৪০ বর্গফুটের ছোট ছোট এক-একটা কামরায় অফিস করেন। সেখানে আবার অর্ধেকের বেশি জায়গার দখলে থাকেন শাখা কর্মকর্তা অর্থাৎ উপসচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিব। বাকি অংশে তিন-চারজন কর্মচারী তাদের কম্পিউটার, প্রিন্টারসহ সব অফিস সরঞ্জাম, আসবাবপত্র ও নথির ভেতরে বসে অফিসের কাজকর্ম করে থাকেন। সবার জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি না করে বড় কর্তারা ডেকোরেশনের নামে নিজের কক্ষের সৌন্দর্য ও আয়তন বৃদ্ধি করতে থাকেন। বিধি অনুসারে বড় কর্তাদের নিয়ম করে সব কক্ষ পরিদর্শন করার কথা থাকলেও কোনো সচিব কি তার মন্ত্রণালয়ের সব কর্মচারীর কক্ষ পরিদর্শন করেছেন এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করেছেন? হলফ করে বলতে পারি, বিগত ৩০ বছরে সাবেক ও বর্তমান কোনো সচিব এ কাজটি করেননি। তবে, পরিদর্শন না হলেও অর্থ অপচয় কিন্তু কোনো অর্থবছরই বকেয়া থাকে না।
সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও নিরাপত্তার বিষয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে সিঁড়ির পাশেই ফায়ার কন্ট্রোলের জন্য হোসপাইপ আছে, তবে ওটা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সে ধরনের প্রশিক্ষণ তো দূরের কথা, ব্যবহার নির্দেশিকা পর্যন্ত নেই। এ ছাড়া প্রতি কক্ষে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জরুরি অগ্নিনির্বাপক না থাকলেও প্যাসেজের দেয়ালে তিন-চারটা কক্ষ পরপর একটা করে অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার ঝোলানো আছে, মেয়াদ চলে গেলে ওগুলোর লেবেল পরিবর্তন হয়, মেয়াদ ফিরে পায় কিন্তু ওটা কীভাবে চালাতে হয় সেটা কাউকে শেখানো হচ্ছে না। তাহলে এসব কি শুধু ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ব্যবহারের জন্য? যারা এখানে নিয়মিত অফিস করেন, তাদের কি জরুরি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ব্যবহারের ন্যূনতম জ্ঞানের প্রয়োজন নেই? সচিবালয়ের অনেক কর্মচারী জানেনই না ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেকটর বা ইমার্জেন্সি ফায়ার হাইড্রেন্ট কী? ওগুলো দেখতে কেমন? বেসিক ফায়ার ড্রিল বলতে যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবার জানা উচিত, তা কেউ মনে করেন কি না জানি না। মৌলিক প্রশিক্ষণ না থাকার ফলে আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে আতঙ্কিত হয়ে হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনভাবে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। একজন আহত সহকর্মীকে কীভাবে রেসকিউ করতে হবে তা শেখানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ অথবা পোড়া গেলে বা বৈদ্যুতিক শকে কী ধরনের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে হবে বা জরুরি বহির্গমন কীভাবে নিশ্চিত করতে হবে তার গুরুত্ব চিন্তা করার মতো সময় আমাদের কোথায়?
১৬ মার্চ, ১৯৯২ তারিখে একটি আদেশ জারি করে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (সচিবালয়) ক্যাডার’ বিলুপ্ত করা হয়। ফলে সচিবালয়ের ক্ষমতা প্রশাসন ক্যাডারের হাতে চলে যায়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের চাকরি জীবনের অল্প কিছু সময়ের জন্য এক একটা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পদোন্নতি পেয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে কিংবা মন্ত্রণালয়ের বাইরের দপ্তর/সংস্থায় চলে যান। নন-ক্যাডার পদে যারা চাকরি করেন তারা আজীবন এ জঘন্য কর্মবান্ধবহীন পরিবেশে, গুমোট কক্ষগুলোতে চাকরি করতে করতে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অবসরে গমন করেন। অবসর ভাতা ও পেনশন বাবদ প্রাপ্ত টাকার বেশিরভাই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে খরচ হয়ে যায়। সচিবালয়ের জন্য আলাদা ক্যাডার থাকলে তারা একই ক্যাম্পাসে এন্ট্রি পদ হতে পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে সচিব/সিনিয়র সচিব হয়ে অবসরে যেতেন তখন তাদের মধ্যে একটা বন্ডিং বা সহকর্মীর প্রতি সহমর্মিতা তৈরি হতো। সবার জন্য সমান সুযোগের মানসিকতা তৈরি হতো। বৈষম্য তৈরির সুযোগ কমে যেত। কিন্তু ক্ষণিকের অতিথির মতো এসে প্রশাসন ক্যাডারের অফিসাররা তাদের নিজ নিজ সুবিধার বাইরে বাকিদের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্ন কর্মপরিবেশ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার কথা একচুলও ভাবেন বলে মনে হয় না। যদি ভাবতেন তবে লোকদেখানো ডেকোরেশন করার আগে প্রতিটি কক্ষে অন্তত ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেকটরের মতো জরুরি যন্ত্রাংশ স্থাপন করার ব্যবস্থা নিতেন। শুধু সচিবালয়ের জন্য ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটা আলাদা ফায়ার স্টেশন থাকত। নিয়মিত বেসিক ফায়র ড্রিল প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ জনকে বেসিক ফায়ার ওয়ার্ডেন ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। প্রত্যেক কর্মচারী বেসিক ফায়ার ড্রিল; বেসিক ফাস্ট এইডের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণগুলো পেত, যা পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার হতো। একটা মাত্র লুজ কানেকশনের আগুন ৭ নম্বর ভবনে দৃশ্যমান হয়েছে। সচিবালয়ের অভ্যন্তরের এমন হাজারো অদৃশ্য লুজ কানেকশন ঠিক করবে কে? নোংরামি যখন শিকড়ে তখন পরিচ্ছন্ন দেশ কীভাবে পাব?
লেখক: সরকারি কর্মকর্তা