ইসরায়েলের আগ্রাসনের ফিলিস্তিনে ঘটেছে একুশ শতকের এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। গাজায় যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে, এর পরিমাণ পাঁচ কোটি টনের বেশি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ধ্বংসস্তূপ সরাতে ২১ বছর লাগবে। আর খরচ হবে অন্তত ১২০ কোটি মার্কিন ডলার। ইসরায়েলের হামলায় গাজার বেশিরভাগ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ধসে পড়া বাড়িঘর পুনর্নির্মাণে অন্তত ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। তবে এটি কয়েক দশকও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইসরায়েলের হামলায় আহত এমন সংকটাপন্ন ২ হাজার ৫০০ শিশুকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত গাজা থেকে তৃতীয় কোনো দেশে নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এ নিশ্চয়তাও দিতে হবে, চিকিৎসা শেষে এসব শিশু যেন আবার গাজায় তাদের পরিবারের কাছে ফিরতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, গাজায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। উপত্যকাটির অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগবে। গাজায় যুদ্ধ থামলেও দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। যুদ্ধবিরতির পর ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রতিদিন কয়েক ডজন করে মরদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাবে, গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে গাজায় তিন শতাধিক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আর গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ১০ হাজারের বেশি মরদেহ চাপা পড়ে রয়েছে। এসব মরদেহের একটা বড় অংশই পচে-গলে গেছে।
ইসরায়েলের ১৫ মাসের নির্বিচার হামলায় গাজার ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন লক্ষাধিক। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো উপত্যকা। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিরা বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। এরপর প্রতিদিনই ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধার হওয়ার খবর আসছে। জাতিসংঘের ত্রাণ ও মানবিক সহায়তাসংক্রান্ত সংস্থা (ওসিএইচএ) শুক্রবার জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ৩৫৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৭১টি মরদেহ। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের খোঁজে উদ্ধার অভিযান চলছে। উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারাও হাত লাগাচ্ছেন। সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় সংস্থাটির ৪৮ শতাংশ কর্মী নিহত, আহত অথবা বন্দি হয়েছেন। ইসরায়েলের হামলায় তাদের ৮৫ শতাংশ যানবাহন ও ২১টি কার্যালয়ের মধ্যে ১৭টি ধ্বংস হয়েছে। এর পরও জীবিত মানুষ ও মরদেহের খোঁজে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে সংস্থাটি। বিবিসিতে প্রকাশিত কিছু ছবিতে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধারকর্মীরা মৃত শিশু ও মানুষের খণ্ডাংশ উদ্ধার করছেন। অনেকটা খালি হাতে উদ্ধারকাজ করতে হচ্ছে তাদের।
এখন আমরা এক বৈশ্বিক সংকটের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে একে পুরোপুরি বুঝতে এবং সমাধান করতে হলে, এর গভীরতর কাঠামোগত কারণগুলো এড়িয়ে গেলে চলবে না। এসব ঘটনার শিকড় ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তির আরও আগে গিয়ে খুঁজতে হবে। এই শিকড় অনুসন্ধানের মধ্যে পড়বে জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান, বদলে যাওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং প্রতিশোধস্পৃহা। এসব কারণই সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে এবং সমাজকে বিভক্ত করছে। এরই ধারায় ফিলিস্তিনিরা এক বিপদ থেকে আরেক বিপদের মধ্যে পতিত হচ্ছে। আরও দুঃখের বিষয় এই যে, তাদের এই দুঃখের শেষ কোথায়—এ প্রশ্নের কোনো উত্তর এখন আমাদের কারও কাছেই নেই।