৮ বছরের একটা শিশু কী বুঝে—সে পুরুষ নাকি নারী? তার শরীরও কি বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে! অথচ এই বয়সের একটি শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণ! মাগুরায় ৮ বছরের শিশুটি বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে এমন নৃশংসতার শিকার হয় গত ৬ মার্চ।
অপরাধীরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, চেষ্টা করেছে তাকে হত্যা করারও। ধর্ষণের সময় কোন ধরনের পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে সেটা ডাক্তারের রিপোর্ট দেখলে বুঝতে পারবেন। ডাক্তারদের ভাষ্যে, সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন বলেই এই শিশুটি বেঁচে আছে। তার ওপর যে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে, সেখান থেকে জীবিত ফেরা অলৌকিক ঘটনা। বর্তমানে শিশুটি হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
এ ঘটনায় সমাজের সব মহল বিচার চেয়েছে, নিন্দা জানিয়েছে। ঢাবি, রাবি, ইবি, শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জনও করা হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে। শিশুটির বড় বোনের ভাষ্য অনুযায়ী, তার শ্বশুরের দ্বারা সে-ও নির্যাতনের শিকার হন। বিষয়টি স্বামীকে তিনি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। পরে বাবার বাড়ি চলে যান। আর স্বামীর বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন না। বাবা-মা বুঝিয়ে ছোট বোনকে সঙ্গে করে পাঠিয়ে দেন শ্বশুরবাড়ি। আর সেটাই বিপদ ডেকে আনল। আপনাদের হয়তো রাজধানীর ডেমরার ঘটনাটা মনে আছে। বাসার খাটের নিচ থেকে দুটি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার নাম করে শিশু দুটিকে বাসায় ডেকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে কিছু পশু। ব্যর্থ হয়ে শিশু দুটির একজনকে গলা টিপে এবং আরেকজনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।
আবার আপনি যদি রাজধানীর তুরাগের ঘটনাটা মনে করেন, স্কুল থেকে ফেরার পথে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার চেষ্টা করে এক যুবক। শুধু কী তা-ই! আপনি অবাক হবেন, দুই বছর দশ দিনের শিশুকে যখন ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এমন ঘটনাও ঘটেছে ২০১৯ সালে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায়। প্রশ্ন হলো এটুকু একটা বাচ্চার মাঝে কী পায় পশুরা? দিনের পর দিন এভাবে ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুর সঙ্গে অন্যায় চলছে আর চলছে। এ বিষয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কঠোর ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও রাষ্ট্র এখনো কঠোর হতে পারছে না। কঠোর হলে এমন ঘটনা কিঞ্চিৎ হলেও কমত বলে মনে করি।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সাড়ে ৩ বছরে ২২০৪ শিশু ধর্ষণের শিকার। এর মধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাস পর্যন্ত ২২৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৭১ জন মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরিসংখ্যান দেখে এটা অন্তত বোঝা যায়, আমাদের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন। গবেষণায় দেখা যায়, ঘরে ঘরে নিকটাত্মীয় কর্তৃক ধর্ষিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার বেশি হয় শিশুরা। শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে পরিবারে, নিকটাত্মীয় দ্বারা। এসব ঘটনার অনেক কিছুই প্রকাশ পায় না। একইভাবে শিক্ষিত মহল, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেও অনেক দুর্ঘটনা রয়েছে, যা প্রকাশ পায় না।
ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সুসংগঠিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বিস্তার ঠেকাতে হবে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদানও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করতে হবে। তাহলেই আমরা এ ভয়াবহতা এবং অমানবিকতা থেকে রক্ষা পেতে পারি। ধর্ষণের বিচার হওয়া উচিত দ্রুত। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার এ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে, দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে অপরাধীদের।
আজহার মাহমুদ, খুলশী-১, চট্টগ্রাম
মন্তব্য করুন