রাজনীতির ময়দানে ঘটনা প্রবাহের অনেক কিছুই এখন দৃশ্যমান। তবে পর্দার অন্তরালে কোনো তৎপরতাই কি নেই? চোখে দেখা নানামুখী তৎপরতার সূত্রগুলো এক করলে নেপথ্যের অনেক কিছুরই আভাস পাওয়া যায়। সময় যত গড়াচ্ছে ততই নতুন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে। জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ধোঁয়াশা কিছুতেই কাটছে না। কেন এই ধোঁয়াশা, তা নিয়ে রয়েছে গুঞ্জন। গুঞ্জন আছে সরকারের ভেতর সরকারের অস্তিত্ব নিয়ে। বিএনপি মনে করে, সরকার নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। এর পেছনে সরকারের একাধিক উপদেষ্টার মদদ রয়েছে। ধর্মভিত্তিক উগ্র দল ও গ্রুপের প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পর্দার অন্তরালে থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর অনেকটাই আকস্মিকভাবে রাজধানীতে শোডাউনের চেষ্টা করেছে। গণহত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করার প্রস্তুতি চলছে। দল হিসেবে একই অভিযোগে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগকে কখনো নিষিদ্ধ আবার কখনো নির্বাচনী অযোগ্য ঘোষণার দাবি নবগঠিত এনসিপির। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে বড় দলগুলো মৌন ভূমিকা পালন করছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চিন্তা এ মুহূর্তে সরকারের নেই, প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক মন্তব্য থেকে এমনটাই মনে হয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূস বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে কি না, সে সিদ্ধান্ত দলটি নেবে। তবে ভারতে আশ্রয় নিয়ে শেখ হাসিনা এবং পালিয়ে যাওয়া সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে বাইরে থেকে দেশের ভেতরে থাকা নেতাকর্মীদের কাছে বিভিন্ন নির্দেশনা আসছে। আগামী দিনে পর্দার অন্তরালে এই তৎপরতা আরও বাড়বে, এমনটা ধারণাই করা যায়।
বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিপরীতমুখী অবস্থান অনেকটাই স্পষ্ট। বিশেষ করে ভারত ও চীনের সাম্প্রতিক ভূমিকায় এ বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ভারতের মিডিয়া হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বেশ জোরে জোরে জারি রেখেছে। বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়েও ভারতীয় গণমাধ্যম বিভিন্ন ধরনের খবর প্রকাশ ও প্রচার করছে। সেনাবাহিনীর ভেতর অভ্যুত্থান ও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে, মর্মে ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে। এসব গণমাধ্যমের মধ্যে দ্য ইকোনমিক টাইমস এবং দ্য ইন্ডিয়া টুডে রয়েছে। আইএসপিআর জানিয়েছে, সেনাবাহিনী নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ভিত্তিহীন। গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন জোগানো ভারত এখন বলছে, বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংহকে ঢাকায় পাঠিয়ে এইচ এম এরশাদকে চাপ দিয়ে নির্বাচনে রাজি করায় ভারত। আগামীতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলেই সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় সেনাপ্রধান। এমন মন্তব্য তিনি আগেও করেছেন। বিপরীতে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ার মতো। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের পাশাপাশি বৈঠক করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে। চীনের আমন্ত্রণে বিএনপির একটি বড় প্রতিনিধিদল দেশটি সফর করে এসেছে। চলতি মাসের শেষে বিশেষ উড়োজাহাজ পাঠিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসকে বেইজিং নিয়ে যাচ্ছে চীন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তার এই সফরে ঢাকা-বেইজিং রাজনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের এক জরিপে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঢাকার সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্কে বেইজিং বেশ এগিয়ে।
এদিকে রমজান মাসে রাজনীতি চলে গেছে ইফতারের টেবিলে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অনেক দলই ইফতার পার্টির আয়োজন করে চলেছে। ইফতারের দোয়ার আগে দলগুলো যার যার রাজনৈতিক অবস্থানের কথা তুলে ধরছে। নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে, এই বাহাস এখনো থেমে নেই। এনসিপির কোনো কোনো নেতা নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার বিচার দাবি তুলে বলেছেন, ফ্যাসিস্টের বিচারের আগে নির্বাচনের কথা বলা যাবে না। তবে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এক পা এগিয়ে আবার দু পা পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন সম্ভব হতে পারে। পরে তিনি বেশি সংস্কার চাইলে নির্বাচন মার্চের মধ্যে হওয়ার কথা বলেন। শুক্রবার জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজে’ একমত হলে নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে। আর ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করলে নির্বাচনে হবে আগামী বছরের জুনের মধ্যে। নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে কালক্ষেপণ করছে, এমন সন্দেহের তীর অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দলকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছে, এটাই মূল অভিযোগ। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন বিলম্বিত করানোর ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগ অস্বীকার করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে এখনো সমস্যার মুখে পড়ছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব নয়। তবে দাবিতে অটল থাকতে পারছে না এনসিপি। রাষ্ট্রপতির অপসারণ, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য সময়সীমা দেওয়া এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন, গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলছেন এনসিপি নেতারা। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো দাবিতে এই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি তারা। শুধু ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিটিই পূরণ হয়েছে। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়, ৭ মার্চ এ বক্তব্য দেওয়ার চার দিনের মধ্যে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে নাহিদ ইসলাম বলেছেন সরকারের প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব। ১১ মার্চ এক ইফতার মাহফিলে এনসিপির আহ্বায়ক সংসদ এবং গণপরিষদ নির্বাচন একই সঙ্গে আয়োজনের দাবি জানান। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে নতুন সংবিধান এবং গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ করা যাবে। সরকার যে নির্ধারিত সময়সীমা দিয়েছে, এর মধ্যে এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া সম্ভব। দলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরে আসা নাহিদ ইসলাম প্রস্তাবিত জুলাই সনদ দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান। নাহিদ ইসলাম এর আগে বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশে সুদূর প্রসারী সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। তরুণ প্রজন্ম যেসব কারণে জীবন দিয়েছে সেসব সংস্কারেও আগ্রহী নয় তারা।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের জন্য আবারও ডিসেম্বরের সময়সীমা ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার সময়সীমা অতিক্রম করতে চায় না। ১০ মার্চ ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা কুকের সঙ্গে বৈঠকের পর সিইসি সাংবাদিকদের বলেছেন, এই সময়সীমা যাতে পার না হয়, সেজন্য ইসি সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে হলে অক্টোবরে তপশিল ঘোষণা করতে হবে। এদিকে অন্তর্ভুক্তি সরকারের বহুল ঘোষিত এবং অন্যতম প্রধান এজেন্ডা সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ছয়টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ, পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ ৩৪টি রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চিঠিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কার প্রস্তাবনার বিষয়ে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়েছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার বিষয় আলোচনা শুরু হবে। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সে সময় থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার বিষয়ে আলোচনা শুরু হবে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ক্রম অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সাত মাসেও সরকার এ ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারেনি। বরং মব সহিংসতা, নারী নিপীড়ন, ধর্ষণের ঘটনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। শিশু আছিয়াকে পাশবিকভাবে ধর্ষণের ঘটনায় গোটা দেশ ফুঁসে উঠেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত শেষ করতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশও মব সহিংসতার শিকার হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা নারী দিবসের অনুষ্ঠানে বলেছেন, পতিত স্বৈরাচার দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। সরকার থেকে যে বক্তব্যই দেওয়া হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, দ্রুত আইনশৃঙ্খলার পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা দুরূহ হবে।
ঈদের পরে রাজনীতি আবার মাঠে গড়াবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ অনেক বেড়ে যাবে। অবশ্য সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে যার যার এলাকায় ছুটতে করতে শুরু করেছেন। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে বিএনপি, সমমনা দল ও বামজোট সোচ্চার হবে—এমন আভাস আগেই পাওয়া গেছে। নবগঠিত এনসিপি দল গোছাতে সারা দেশে তৎপরতা শুরু করবে। সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য কমিশন কতটা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এদিকে সবার দৃষ্টি থাকবে। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া আলোচনায় থাকবে গণপরিষদ, গণভোট ইত্যাদি প্রসঙ্গ। পর্দার অন্তরালেও রাজনীতি নিয়ে চলবে নানামুখী তৎপরতা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন