বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আমরা নদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করি কিন্তু নদীর পাড়ে বসবাসকারীরা এর ভয়াল রূপের শিকার হয়। নদীভাঙনের ফলে বসতভিটা, আবাদি জমি, রাস্তাঘাট গিলে নিতে থাকে হিংস্র নদী। প্রতি বছর এভাবে বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয় আর ঘরবাড়ি, ফসলের জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ। সমগ্র বিশ্বে নদীভাঙন একটি অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে, সাধারণত বর্ষাকালে উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুন নদীর পানি বেড়ে যায় এবং তা প্রচণ্ড গতিতে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। এ সময় উপকূলীয় অঞ্চলের নদীসংলগ্ন স্থলভাগে পানির তীব্র তোড়ে সৃষ্টি হয় নদীভাঙনের। বাংলাদেশে এটা স্বাভাবিক চিত্র হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় তা আর স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার প্রায় ১২০০ কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছে। আরও প্রায় ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিতে পারে। এতে কৃষিজমির এক বিরাট অংশ নদীতে তলিয়ে যাবে। অথচ এর বিপরীতে যে চর জেগে উঠছে, তা অপ্রতুল। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (CEGIS) উপগ্রহের মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে যে, ১৯৭৩-২০০৮ সাল পর্যন্ত ভোলার মূল ভূভাগ থেকে ২৪০ বর্গকিলোমিটার জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ২০০৯ সালের প্রেক্ষাপটে হাতিয়ার উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাংশের তমরদ্দি, চরকিং ও চরঈশ্বর ইউনিয়ন এবং সুখচর ও নলচিরার অবশিষ্টাংশ ব্যাপক ভাঙনের কবলে রয়েছে। নদীভাঙনের পর হাতিয়া উপজেলা পরিষদ ১৯৮৫-৮৬ সালে বর্তমান উপজেলা সদর ওছখালিতে স্থানান্তর করা হয়। ভাঙনের কবলে এরই মধ্যে রাজকুমার সাহার হাট, মনু বেপারির হাট, হিজিমিজির বাজার, নায়েবের হাট, সাহেবের হাট, নলচিরা বাজার, সাহেবানী বাজার, চৌরঙ্গী বাজার, জাইল্লা বাজার, মফিজিয়া বাজার, নলচিরা নতুন বাজার ও ভুঞার হাট মেঘনায় হারিয়ে গেছে। হাতিয়া উপজেলা সরকারি কমিশনার (ভূমি) অফিসসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভাঙনের কবলে উপজেলার সাগরদি, চরবাটা, মাইজচরা, চর হাসান-হোসেন, চরকিং, উত্তর চরকিং, কাউনিয়া, চরবগুলা, চরআমানুল্লাহ, দক্ষিণ চরআমানুল্লাহ মৌজাগুলো মেঘনায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া আরও ২০টি মৌজার বেশিরভাগই নদীতে হারিয়ে গেছে।
হাতিয়া যে হারে ভাঙছে, সে হারে নতুন জমি হাতিয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। সিইজিআইএসের উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষিত মত হলো, ১৯৭৩-২০০৮ সাল পর্যন্ত হাতিয়ার মূল ভূভাগ থেকে ১৫০ বর্গকিলোমিটার জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। দেখা যায়, হাতিয়ার চারদিকই ভাঙছে, তবে প্রবণতা বেশি উত্তর দিকে। পলি জমে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাত বর্গকিলোমিটার জমি যুক্ত হলেও ভাঙনের তুলনায় তা যৎসামান্য।
এ ভাঙনের ফলে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীভাঙনের ফলে এ দেশে প্রতি বছর ২৫ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। জাতীয় অর্থনীতি হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। উন্নত বিশ্বের নদীভাঙনের মাত্রা বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু দারিদ্র্য ও স্বল্পোন্নত দেশে এর ভয়াবহ রূপ ফুটে ওঠে। মানুষ সবকিছু হারিয়ে দুস্থ, নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। সাতক্ষীরা আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নবাসীর ঈদের দিন রাত কেটেছে নির্ঘুম। খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে জোয়ারের তোড়ে রাতে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ইউনিয়নের ২০ হাজারের বেশি মানুষ। ভেসে গেছে চার শতাধিক মৎস্যঘের। তলিয়ে গেছে ৫০০ বিঘা বোরো ধান। ঘরবাড়ি ছেড়ে তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে অন্যত্র। অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর এরকম নদীভাঙনের সম্মুখীন হচ্ছে।
নদীভাঙনের আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। প্রতি বছর এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি করে চলেছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৬৮ হাজার মানুষ নদীভাঙনের ফলে বাস্তুচ্যুত হয়। এমনকি পদ্মা ও যমুনা নদী গত ২২ বছরে প্রায় ৫০৯৫৫ হেক্টর ভূমি গ্রাস করেছে, ফলে অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
নদীভাঙন রোধে সরকারকে বহুমুখী ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং ও নদী খননের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যাতে নদীর গভীরতা ঠিক থাকে এবং দিক পরিবর্তনের প্রবণতা কমে। দ্বিতীয়ত, নদীতীর সংরক্ষণের জন্য জিওব্যাগ, কংক্রিট ব্লক কিংবা অন্যান্য টেকসই উপকরণ দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া নদীতীর বনায়নের মাধ্যমে মাটি ধরে রাখা সহজ হয়, যা ভাঙন প্রতিরোধে সহায়ক। পরিকল্পিত ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদীর আশপাশে অপ্রয়োজনীয় গৃহনির্মাণ বা কৃষিকাজ সীমিত রাখা দরকার। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করে কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তিগতভাবে ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করতে উপগ্রহ চিত্র, জিআইএস ও ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। সবশেষে, একটি দীর্ঘমেয়াদি নদী ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। এসব উদ্যোগ সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করলে নদীভাঙনের ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।
ফারিয়া ইয়াসমিন তিশা, শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন