অন্তরালে কী ঘটছে? নির্বাচন কি ডিসেম্বরে, নাকি ২৬-এর জুনে, নাকি আরও প্রলম্বিত হবে? অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে অথবা থাকতে চাচ্ছে? কম সংস্কার, বেশি সংস্কার—কোন সংস্কারের অভিমুখে যাবে দেশ? নির্বাচনের আগে গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিচার কি দৃশ্যমান করা যাবে? ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা ও তার দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী? আওয়ামী লীগকে কি নিষিদ্ধ অথবা দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হবে? শেখ হাসিনাকে কি ভারত আদৌ প্রত্যর্পণ করবে? আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন? সদ্য ঢাকা সফর করে যাওয়া ট্রাম্প প্রশাসনের দুই কূটনীতিকের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূস ও তার প্রশাসনের এবং তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সিরিজ বৈঠকে কী বার্তা আদান-প্রদান হলো? ১৫ বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের সফর বাংলাদেশের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে? অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারের টানাপোড়েন কি চলতে থাকবে? মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনার প্রবাহ ভূরাজনীতিতে কী ইঙ্গিত বহন করে?
এসব প্রশ্ন রাজনীতির ময়দানে, গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে এবং জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে অনেক গুঞ্জন। হাওয়ায় ভাসছে অনেক গুজব। ঘুরেফিরে প্রশ্ন একটাই, এখন কী হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে কী ঘটতে যাচ্ছে? রাজনৈতিক দৃশ্যপটইবা কী দাঁড়াচ্ছে? এ নিয়ে অনেক কিছুই ধারণা করা যায়, হয়তোবা অনুমানও করা যায়। তবে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারবেন—এমনটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। দেশ কি তাহলে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে? গত কদিনে কয়েকটি বৈঠক, প্রধান তিন রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতমুখী বক্তব্য রাজনীতিতে যথেষ্ট উত্তাপ ছড়িয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা পুনরুল্লেখ করেছেন। বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, বৈঠকের ফলাফলে তারা একেবারেই সন্তুষ্ট নন। তাদের বক্তব্য, সংসদ নির্বাচনের ‘কাট অফ সময়’ ডিসেম্বর। নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে না হলে দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তা আরও খারাপের দিকে যাবে। আর তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নির্বাচন কোনোভাবেই আগামী বছর জুনের পর যাবে না। যে যাই বলুক না কেন, এটাই পুরো জাতির কাছে প্রধান উপদেষ্টার অঙ্গীকার। নির্বাচনে রোডম্যাপ নিয়ে সরকারের অবস্থান সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পরের দিনই করণীয় ঠিক করতে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছে না সরকার। নির্বাচন ২০২৬ সালের জুন পেরিয়ে ডিসেম্বরে চলে গেলেও সরকারের কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচনকে সরকার কার্যত আমলে নিচ্ছে না। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন বিলম্বিত করতে নানা পক্ষ কাজ করছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেগুলো গুছিয়ে আনছে না সরকার।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ‘আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন’ চায় তার দল, এমন বক্তব্য দেওয়ার এক দিন পর নির্বাচনের জন্য তিন শর্তের কথা জানান। ১৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান দলের আমির। তিনি মনে করেন, নির্বাচনের জন্য আগামী বছর জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, ঝড়ঝাপ্টা, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে। তখন ইলেকশন না হওয়ার আশঙ্কায় দেখা দেবে। এর এক দিন পর ভিন্ন সুরে কথা বলেন জামায়াতের আমির। সংস্কার, জুলাই গণহত্যার বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক সহাবস্থান—সংসদ নির্বাচনের জন্য এই তিন শর্ত দেন তিনি। সংবাদ সম্মেলন ডেকে জামায়াতের প্রধান বলেন, ‘জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী এসব ম্যানডেটরি দাবি পূরণ হলে আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হতে পারে।’
সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির। এ সাক্ষাতের খবর প্রচার হওয়ার পর রাজনীতিতে কৌতূহল তৈরি হয়। একসময় রাজনৈতিক মিত্র, জোট সরকারের শরিক জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে বিরোধে জড়ায় দল দুটি। ধারণা করা হচ্ছিল, লন্ডনে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠকের পর নির্বাচন প্রশ্নে কাছাকাছি এসেছেন তারা। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হওয়া নিয়ে তিন শর্ত জুড়ে দেওয়া তার প্রমাণ। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানারকম বক্তব্য দিয়ে চলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। তারা নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রকাঠামোর গুণগত সংস্কার, জুলাই গণহত্যার বিচার এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছেন। এনসিপি নেতারা একসঙ্গে গণপরিষদ ও জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেছেন। শনিবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এনসিপি সংবিধানের মূলনীতি রাখার প্রয়োজন আছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী শাসিত নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রস্তাব করেছেন দলটির নেতারা। তবে সম্প্রতি এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের একটি বক্তব্য রাজনীতিতে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়, অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, ‘প্রশাসন অনেক জায়গায় বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। এ ধরনের প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়। মৌলিক সংস্কার ছাড়া এনসিপি নির্বাচনের অংশ নেবে না।’ এখানে উল্লেখ করা যায়, এনসিপি আগে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এবার দলটি প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলল। নির্বাচন, সংবিধান ও সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নতুন দল এনসিপির বিপরীতমুখী অবস্থান, বলতে গেলে শুরু থেকেই ছিল। দল দুটি অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছে। বলা যায়, এখনো তা চলেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি নেতারা শুরু থেকে বলছেন যে, শুধুমাত্র আরেকটি দলকে ক্ষমতায় বসানো গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল না। বিএনপি নির্বাচনের জন্য অস্থির হয়ে গেছে, এমন বক্তব্য মাঝেমধ্যেই দিচ্ছেন এনসিপির নেতারা। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ, ছাত্রদের দল গোছানোর জন্য সময় দিতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে কালক্ষেপণ করছে। ‘প্রশাসন বিএনপির পক্ষে, ভোট সম্ভব নয়’—নাহিদ ইসলামের সর্বশেষ এ বক্তব্য নির্বাচন প্রলম্বিত করার নতুন কৌশল বলে মনে করছে বিএনপি। এতসব কিছুর পর তাই জনমনে প্রশ্ন, নির্বাচন কবে হবে? নির্বাচন হওয়া বা না হওয়া নিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুঞ্জন। এই গুঞ্জন জোরালো হচ্ছে, কোনো কোনো উপদেষ্টার বক্তব্য এবং কিছু জরিপ ও সামাজিকমাধ্যমের প্রচারে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, জনগণ চায় এ সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক। এর বেশ আগে ধর্ম উপদেষ্টা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনের পর ছয় মাসের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার বাকি মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারে। সামাজিকমাধ্যমে প্রফেসর ইউনূস সরকারের পাঁচ বছর ক্ষমতা থাকার পক্ষে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে প্রচার চালাচ্ছেন। এ ধরনের প্রচারের বিষয়ে বিএনপিসহ সমমনা দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিকোল চুলকি ও পূর্ব এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যান্ড্রু আর হেরাপ সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এটাই কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম ঢাকা সফর। ঢাকায় নেমে তারা বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করে। এসব বৈঠকে আগামী নির্বাচন, সংস্কার কর্মসূচি, গণতন্ত্রের পথে যাত্রা, শেখ হাসিনার বিচার, বাণিজ্য সুবিধা, রোহিঙ্গাসহ প্রায় সব ইস্যুতে দল তিনটির চিন্তাভাবনা, মতামত, ক্ষমতায় গেলে তারা কী কী করবে, ট্রাম্প প্রশাসনের এ দুই কূটনৈতিক তা জানতে চেয়েছেন। তারা প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই মার্কিন কূটনীতিকের সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাদের সফরের খুঁটিনাটি বা আলোচনার সবকিছুই প্রকাশ পেয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। এ ছাড়া তাদের সফরের সময় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঢাকায় আসাটাও তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও তার সফরের বিষয়ে তেমন কিছুই গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি।
এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জারি রয়েছে, তখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছে দলটি। ভারতসহ কয়টি দেশ আগামী নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করার কথা বলছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে, পেলে কাদের নেতৃত্বে অথবা গণহত্যার অভিযোগে নিষিদ্ধ হবে নাকি নিবন্ধন হারাবে—এসব প্রশ্নের জবাব এক্ষুনি মিলবে না। তবে শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে প্রত্যর্পণে বাংলাদেশের দাবির বিষয়ে ভারত অনুকূল সাড়া দেবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির ৪০ মিনিটের শীর্ষ বৈঠকের পর বরফ গলতে শুরু করবে বলে যারা ধারণা করেছিলেন, তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং ভারত বাংলাদেশ থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দুই দেশের বর্তমান জটিল সম্পর্ক সহসা কাটবে— এমনটা মনে করা যাচ্ছে না। ঢাকা সফর করে গেলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ। ২৭ এপ্রিল ঢাকায় আসবেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক প্রতিবেশী ভারত কীভাবে নেয় তাও দেখার বিষয়। দেশের রাজনীতি, নির্বাচন, গণহত্যার বিচার, সংস্কার, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ইত্যাদির পাশাপাশি ভূরাজনীতি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি—এসব বিষয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন ও সংশয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন