প্রত্যক বাবা-মা চান তাদের সন্তান সুস্থ-সুন্দরভাবে জন্মলাভ করুক। কিন্তু কারও কারও এ স্বপ্ন ভেঙে যায় জানা-অজানা নানা কারণে। পরিসংখ্যানমতে, প্রতি ৩০টি বাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চা কোনো না কোনো জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কোনো বাচ্চা শারীরিক বা গঠনগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায় আবার কোনো বাচ্চা জেনেটিক বা ডিএনএজনিত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। শারীরিক বা গঠনগত ত্রুটির কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসা থাকলেও বেশিরভাগ জেনেটিক ত্রুটির চিকিৎসা নেই বা থাকলেও অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অসম্পূর্ণ। দেশ ও জাতিভেদে জন্মগত ত্রুটির ধরন ও কারণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। অনেক সময় বাবা-মা জেনেটিক রোগের বাহক হলে তাদের সন্তান ওই জেনেটিক রোগ নিয়ে জন্মায়। আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া একটি মারাত্মক জেনেটিক/জন্মগত রক্তরোগ। যেসব সমাজে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিয়েশাদি বেশি প্রচলিত, সেসব সমাজে থ্যালাসেমিয়ার মতো বংশগত রোগবালাই বেশি। বাবা-মা এ রোগের বাহক হলে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না। শিশুর বয়স এক বা দুই বছর হলে শিশুর রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারি অঙ্গ যেমন প্লিহা, যকৃৎ বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমণ্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারণে শিশুর চেহারা বিশেষ রূপ ধারণ করে, যা দেখে চিকিৎসক সহজেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে চিহ্নিত করতে পারেন। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র চিকিৎসা, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সবসময় সফল নয়।
প্রতিরোধের উপায়: সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ রোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরির তেমন উদ্যোগ নেই। একটু সচেতন হলেই আমরা এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। পৃথিবীর অনেক দেশে যেমন সাইপ্রাস ১৯৭৩ সালে, বাহরাইন ১৯৮৫, ইরান ২০০৪, সৌদি আরব ২০০৪ এবং সর্বশেষ পাকিস্তান ২০১৩ সালে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়া আছে কি না, তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে থ্যালাসেমিয়া রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। যে কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হতে পারে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই জানা যায় কেউ থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না। বাবা ও মা দুজনই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলেই কেবল সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একজন বাহক এবং অন্যজন সুস্থ এমন দুজনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে সন্তানদের কোনো সমস্যা হবে না। রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে বিশাল রক্তের ভান্ডার প্রয়োজন হচ্ছে। আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়ে আর্থিক দৈন্য ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে লাখো বাবা-মা। শুধু তাই নয়, বাবা-মায়ের সামনেই ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বেশিরভাগ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া এখন এক নীরব মহামারি যাতে প্রতি বছর হাজার হাজার শিশুর মৃত্য হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে বাবা-মায়ের স্বপ্ন। অথচ শিশু মৃত্যুর হার কমানো আমাদের এসডিজি লক্ষ্য। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য ৮ মে পৃথিবীব্যাপী বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালন করা হয়। থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা নিয়ে আগ্রহ বা আলোচনা হলেও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে তেমন কথা শোনা যায় না। থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা মানে অন্যের রক্ত নিতে নিতে অকাল মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। দৈনন্দিন জীবনে আমরা ভালো থাকার জন্য কত না পরিকল্পনা করি। আজ বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। আসুন এই দিনে সুস্থ সন্তানের বাবা-মা হওয়ার জন্য, মেধাদীপ্ত দেশ গড়ার জন্য, থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতন হই। মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করি।
লেখক: অধ্যাপক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন