দুটো দেশ যখন যুদ্ধরত অবস্থায় থাকে, তখন তাদের নাগরিকদের মধ্যে দুটি ভিন্ন অনুভূতির সংকট দেখা দেয়। একটি হলো সহানুভূতি, অন্যটি সহমর্মিতা। এগুলো শুধু অনুভূতি নয়, একই সঙ্গে মানবিক গুণ। অন্য কারও অভিজ্ঞতা ও দুর্দশা অনুভব করতে পারাটা একটি গুণ বটে। যেই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যুদ্ধাহতদের যেতে হয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করতে পারা এবং যারা এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, তাদের প্রতি সহানুভূতি অনুভব করতে পারাটা বর্তমানে অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে যে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমন কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায় যাদের মতে সহমর্মিতা হলো দুর্বলতার প্রতীক। তাদের মতে, শত্রুপক্ষের প্রতি মানবিক সংবেদনশীলতা বিজয়ের লক্ষ্যে বাধা সৃষ্টি করে। শত্রুকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য। বস্তুত যুদ্ধ এবং যুদ্ধে নিয়োজিত মানুষকে এভাবে দেখতে চাওয়াটা সঠিক নয়। ভুক্তভোগীদের প্রতি সহমর্মিতা মানবতার স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধের বিভীষিকা, রক্তক্ষয় ও সীমাহীন দুর্ভোগের ইতি টানার জন্য এবং একই সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য এ জাতীয় অনুভূতির প্রয়োজন।
এ পারস্পরিক মানবিকতাবোধ থেকেই বিশ বছর ধরে হাজার হাজার ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নাগরিকরা একটি যৌথ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এ বার্ষিক অনুষ্ঠানে অনন্তকাল ধরে চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে নিহত সব ব্যক্তির প্রতি সম্মান জানানো হয়। যারা এ অনুষ্ঠানে শামিল হন, তারা প্রতি বছর একই আশা নিয়ে এখানে জড়ো হন, যেন চলতি বছরের লাশের সংখ্যা বিগত বছরের থেকে কম হয়।
চলতি বছর ইসরায়েলের ইয়াফা শহরে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের নাগরিক হওয়ায় যারা ইসরায়েলে প্রবেশ করার অনুমতি পাননি, তাদের জন্য অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেইত জালা শহরে একই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যুদ্ধরত দুটি জাতির মধ্যে যে অংশটা একে অন্যের ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েছে, যারা একই শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের নিদর্শন হয়ে আছে এ অনুষ্ঠানটি।
যে দুটি সংগঠন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে তার মধ্যে একটি হলো ‘কমান্ড্যান্টস ফর পিস’, যা একটি দ্বিপক্ষীয় বেসামরিক প্রতিষ্ঠান। ইসরায়েলের অবৈধ নিয়ন্ত্রণ এবং সব ধরনের সহিংসতার বিরোধিতা করে আন্দোলন চালিয়ে আসছে এ প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিতীয় সংঠনটি হলো ‘প্যারেন্টস সার্কেল ফ্যামিলি ফোরাম’, যা যুদ্ধে স্বজন হারানো ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল স্বজন হারানো পরিবারগুলো এবং তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। প্রিয়জনদের স্মরণ করে শান্তির পক্ষে যৌথ আহ্বান জানান উপস্থিত সবাই।
টেলিভিশনের মাধ্যমে ইসরায়েল, ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়, মোট ১৬০টি স্থানে এ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। আমি নিজেও এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। আমার জন্য এটি ছিল একটি অত্যন্ত সম্মানজনক অভিজ্ঞতা। নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছাপিয়ে উঠে যারা প্রবল মানসিক শক্তির পরিচয় দিয়েছেন, যুদ্ধরত প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে যারা নিজেদের দুঃখ এবং কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমার নিজেরও গর্ববোধ হয়েছে।
এ বেদনার ক্ষণে শান্তি আর পুনর্মিলনের বার্তায় অটল থাকাটা কোনো সহজ বিষয় নয়। বিশেষ করে এমন বিভীষিকাময় সময়ে, যখন কি না চারপাশে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, যাদের প্রায় সবাই ফিলিস্তিনি। গত দেড় বছরে যুদ্ধের দরুন এ প্রাণ হারানো মানুষগুলোর নাম যুক্ত হয়েছে সেই দীর্ঘ তালিকায়, যে তালিকা প্রতিনিয়ত বিকৃত আদর্শবাদ আর ব্যর্থ নেতৃত্বের জন্য আরও দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছে। সময়ের সঙ্গে আরও নিষ্ঠুর আর হৃদয়হীন হয়ে উঠছে সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিধিরা।
নিজের নিকটস্থদের হারানোর যে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা, তা কেবল প্রতিপক্ষের ওই ব্যক্তিটাই উপলব্ধি করতে পারে যে স্বয়ং যুদ্ধে নিজের আপনজনদের হারিয়েছে। কারণ কেবল সেই প্রিয়জনকে হারানোর বিষাদের সঙ্গে পরিচিত, সেও একই মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। হোক ফিলিস্তিনের সাধারণ নাগরিক বা ইসরায়েলের, সর্বহারা মানুষগুলো ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাসের শিকার। এই শোক কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা বা রাজনৈতিক বিভাজন মানে না। মৃত্যুর অভিজ্ঞতা ইহুদি-মুসলমান, ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি, সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে।
এ যৌথ স্মরণানুষ্ঠানকে ‘বিকল্প স্মরণ দিবস’ নামেও অভিহিত করা হয়। কারণ একইদিন ইসরায়েলে যুদ্ধে নিহত সৈনিক, নিরাপত্তাকর্মী এবং বেসামরিক নাগরিকদের স্মরণে সরকার বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এর কারণে মৃত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের স্মরণানুষ্ঠান যেন ধামাচাপা না পড়ে যায়, সেজন্য এমনটা করা হয়। তবে বর্তমান সময়ের অসহিষ্ণু পরিবেশে কোনো পক্ষই এমন অনুষ্ঠান সহজে গ্রহণ করতে পারছে না। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের যৌথ কোনো কর্মসূচি, যেখানে দুই দেশের মানুষই অংশগ্রহণ করবে, এমন উদ্যোগ উভয়পক্ষের কর্তৃপক্ষই সন্দেহের চোখে দেখছে এবং এর প্রতি বিরূপ মনোভাব পালন করছে। ইসরায়েলের একটি সিনাগগ (ইহুদিদের উপাসনালয়), যেখানে এ অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার চলছিল, সেখানে একদল উগ্র ও কট্টর ডানপন্থি সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে। কিছু স্থানীয় রাজনীতিবিদ ছিল এ সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের মদদেই অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে আসা অংশগ্রহণকারীদের ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ হামলার ঘটনার বিস্তারিত ছড়িয়ে পড়ে। আর অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা এবং হামলায় সমর্থন দেওয়া লোকদের মন্তব্যগুলো ছিল এত বিকৃত যে, তা পত্রিকায় উল্লেখ করার মতো নয়।
ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও এমন একটা পক্ষ আছে যারা এ অনুষ্ঠানকে দখলদারিত্বের ‘স্বাভাবিকীকরণ’ বলে মনে করছে। তাই গাজায় যেসব পরিবার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাদের আত্মীয়দের বয়ানগুলো বেনামে পাঠ করতে হয়েছে। তবুও তাদের বয়ানে পরিচয় গোপন রেখে স্বজন হারানো ফিলিস্তিনিরা শান্তির ডাক দিয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছে।
নিজেদের বেদনার অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের জানানো এবং মানবিক আহ্বান জানানোর অর্থ কোনোভাবেই অন্যায় দখলদারিত্ব মেনে নেওয়া বা তার স্বাভাবিকীকরণের সমর্থন দেওয়া নয়, বরং এটা অন্যের কাছে নিজের বেদনা প্রকাশ করে তাকে গভীরভাবে অর্থপূর্ণ করে তোলার একটা প্রয়াস মাত্র। সংঘাতের ইতিহাস যদি আমাদের কোনো শিক্ষা দিয়ে থাকে, তবে তা হলো এই যে, বিরোধীপক্ষে লড়াই করা মানুষগুলোর প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি বা সহমর্মিতা প্রকাশ করাই হলো শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পুনর্মিলনের পথে প্রথম পদক্ষেপ। এমন চিন্তা আমাদের মধ্যকার মানবিক সত্তাটা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
বিরোধীপক্ষের সম্পূর্ণ বিনাশেই শুধু নিজেদের সাফল্য নিহিত—এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসের মায়াজালে পড়লে, যুদ্ধে ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে অব্যাহত হত্যাকাণ্ড আর ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দেওয়ার অযৌক্তিক চেষ্টায় অন্যপক্ষের মানুষগুলোকে দানব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তাদের মানবিকতাকে অস্বীকৃতি জানানো হয়। যুদ্ধবাজরা মনে করে, অন্যপক্ষের মানুষগুলোর মানবিক রূপটা কেড়ে নিলেই, যুক্তিসংগতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
আত্মরক্ষার স্বার্থে অন্যকে আক্রমণ করায় কোনো দোষ নেই—শৈশব থেকেই আমাদের এ শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিসরে এ আত্মরক্ষামূলক আচরণকেই পুঁজি করে কখনো কখনো প্রতিশোধপরায়ণতার চর্চা করা হয়। এ হিংস্রতার থেকেই জন্ম নেয় অজুহাতবিহীন ও ক্ষমাহীন একটা সহিংস গোষ্ঠী। এদের কোলাহলে যারা যুদ্ধের দরুন অপরিসীম ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাদের শান্তির বার্তাগুলো হারিয়ে যায়। নিজেদের বেদনাগুলোকে ইতিবাচক রূপ দিয়ে যারা যুদ্ধের ইতি টানতে চায়, তারা সাফল্যের মুখ দেখতে পায় না। অথচ মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বাণীর সঙ্গে তারা সবাই পরিচিত, ‘চোখের বদলে চোখ তুলে নিতে থাকলে, একদিন পুরো পৃথিবীটাই অন্ধ হয়ে যাবে।’
যুদ্ধের দরুন আমরা বিধ্বস্তদের কাছ থেকে যে আকুতি শুনতে পাই, বিশেষ করে তাদের কাছ থেকে যারা নিজেদের পরিবার হারিয়েছেন, সেই আকুতিগুলো আমাদের নৈতিক দিকনির্দেশনার অংশ হওয়া উচিত। যারা এ আকুতিকে অনবরত অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে, তারা হয় সত্যকে ভয় করে, নয়তো তারা সহিংসতা আর ক্রোধের চক্রে এতটাই নিমজ্জিত হয়ে গেছে যে, সেখান থেকে নিজেদের নিষ্ঠুরতা যৌক্তিক বলে মনে করতে শুরু করেছে। এজন্যই হয়তো বারবার তারা ধ্বংসের পথ বেছে নিতে সংকোচবোধ করছে না।
যারা এ সংঘাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং চরমপন্থি মতাদর্শ বা ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা প্ররোচিত, তাদের কাছে অন্যপক্ষের মানবতা নিতান্তই নগণ্য ব্যাপার। তারা বর্তমানে এতটাই কঠোর হয়ে পড়েছে, তাদের কাছে সহানুভূতির আবেদন যেন অরণ্যে রোদন। তবে আশার বিষয় হলো, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডে এরকম আচরণ দেখা গেলেও, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এখনো এভাবে চিন্তা করছে না। তাদের শঙ্কার ভিত্তি হলো নিরাপত্তার ভীতি। এ ভয় আর অবিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে পারলে, একসঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা এবং সহাবস্থান করার সুযোগ তৈরি করতে পারলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়ে যাবে।
বস্তুত ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ যখন একই সঙ্গে সহাবস্থান করে, একসঙ্গে দৈনন্দিন কার্যকলাপে অংশ নেয়, তাদের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে ওঠে, তখনই তারা একে অন্যকে নিজেদের মতোই মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করে। স্মরণীয় মার্কিন কবি মায়া অ্যাঞ্জেলো একবার বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের সবার মধ্যেই সহানুভূতি আছে। শুধু তা প্রকাশ করার মতো সাহস আমাদের সবার নেই।’ এ সত্যটাই ফুটে ওঠে যখন দেখি, যুদ্ধে উভয়পক্ষে প্রাণ হারানোদের স্বজনরা একত্রিত হয়ে শোক ভাগ করে নিচ্ছেন। এ সহমর্মিতা প্রকাশ করার মাধ্যমে তারা সবার জন্যই সাহসের এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে যাচ্ছেন।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং ব্রিটেনের ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে’ মেনা প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েট ফেলো। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন