‘মশা মারতে কামান দাগানো’ বলে প্রবচন আছে। কিন্তু এ প্রবচনকে অনেক পেছনে ফেলে ডিজিটাল যুগে বেশ কিছু আজগুবি কাজ করা হয়েছে ডেঙ্গুর চাপে চ্যাপ্টা হয়ে। যা কি না গোপাল ভাঁড়ের তামাশাকেও হার মানিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। মাছ-ব্যাঙ-পাখি-ফড়িং-হাঁস-মাদার গাছ-ড্রোন—অনেক তামাশাই করা হয়েছে মশা নিধনের নামে। তবে মশা লাইগেশন অথবা সাপ ছেড়ে দেওয়ার তামাশা এখনো করা হয়নি। তাতে অবশ্য কোনো অসুবিধা নেই। কারণ এরই মধ্যে যেসব তামাশা করা হয়েছে, তাই বিনোদনের জন্য যথেষ্ট। এর মধ্যে তামাশা চরমে পৌঁছেছে ড্রোন ও হাঁসে। এদিকে ফাঁস হয়েছে, মশা দমনে ভেজাল বা রহস্যজনক পেস্টিসাইড আনার খবর। আকাশে ড্রোন উড়তে দেখলে শিশুদের ভালো লাগে। আর জলে দলবদ্ধ হাঁস ভাসলে ভালো লাগে শিশু-বড়-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, সবার। কিন্তু সেই হাঁস গায়েব। গেল কই? তা নাকি শিয়ালে খেয়েছে। বেশ কথা! শিয়ালে তো হাঁস খায়ই। কিন্তু ঢাকা শহরে এত শিয়াল এলো কোথা থেকে? হয়তো এই শিয়াল চতুষ্পদী নয়, দ্বিপদী! কত বাহারি নামের দ্বিপদী শিয়ালই তো আছে। এসব কাণ্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যুর মিছিল চলছে সমানে। আক্রান্তদের চাপে হাসপাতালে তিল-ধারণেরও ঠাঁই নেই। এ ব্যাপারে ২৩ আগস্ট গুণধর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০০, আক্রান্ত লক্ষাধিক। বলে রাখা ভালো, এ সংখ্যা কিন্তু সরকারি ভাষ্য। আর কে না জানে, সরকারি ভাষ্য এবং বাস্তবতার মধ্যে অনেক ফারাক! যা কাজির কেতাব আর গোয়ালের হিসাবকেও ছাড়িয়ে যায়। এটি কমবেশি অনেকেরই জানা। কিন্তু জানা যায়নি, ‘মশা মারতে কামান দাগানোর’ প্রবচনের কামান আসলে কোন কামান। তবে মশক উপদ্রুত দেশবাসীর মধ্যে নগরবাসীরা তুলনামূলক বিচারে ভাগ্যবান। কারণ, তারা বেশ কয়েক বছর ধরে গোধূলিলগ্নে এক ধরনের উপদ্রবের মুখোমুখি হন, যা কি না অনেকটা কামানের মতোই বিকট শব্দ করে। সঙ্গে করে বিপুল ধোঁয়া উদগিরণ। এতে মশা মরে, নাকি মরে অন্য প্রাণিকুল, তা কেউ খুব একটা ভেবে দেখেছে বলে মনে হয় না। আর আশরাফুল মাকলুকাতের যে কত ক্ষতি হয়, তা কোনো বিশেষজ্ঞ এখনো ভেবে দেখেছেন কি না তাও জানা যায়নি। তবে অনেকেরই চোখে পড়েছে, মশা মারার নামে আধুনিককালের কামান দাগার সময় নাগরিক পাখিরা অস্থির হয়ে যায়, ছোটাছুটি করে। এদিকে অনেকের বিবেচনায়, মশারাও পাখিদের মতো কাব্যের উপজীব্য হয়ে আছে অনেক আগেই। বিশেষ করে কবিতা ও ছড়ায়।
পাখিদের নিয়ে কবিতার অন্ত নেই। আবার পাখিরা মানুষকে উড়তেও উদ্বুদ্ধ করেছে। কবিতা এবং বাস্তবতায় মিলেমিশে পক্ষীকুল একাকার। বাঙালিদের কাছে সম্ভবত জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পাখি সবচেয়ে মোহনীয়ভাবে ধরা দিয়েছে। যেমন : ‘সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ এমনকি খড়কুটো-বিষ্টায় পরিপূর্ণ পাখির বাসাও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অন্যরকম দোতনা সৃষ্টি করেছে, ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’ মানে আশ্রয়, ভরসা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, মশার কাহনে পাখি বন্ধনা কেন? কোথায় পাখি আর কোথায় মশা! তেলাপোকা হলেও একটা কথা ছিল! কিন্তু মশাকে এত তুচ্ছ করে ভাবা ঠিক নয়। কারণ মশা নিয়েও মনোমুগ্ধকর কবিতা রয়েছে। আর তা এলেবেলে কোনো কবি লেখেননি। লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়, “...মশা!/ক্ষুদ্র মশা!/মশার কামড় খেয়ে আমার-/স্বর্গে যাবার দশা!.../একাই যুদ্ধ করি/এ-হাতে ও-হাতে/দু’হাতেরই চাপড় বাজে/নাকের ডগাতে।/একাই/মশার কামড় নিজের চাপড়/কেমন করে ঠেকাই।.../ কোন নগরের মশার সাথে/তুলনা কার চালাই?” এ কবিতার আরও দুটি পঙ্ক্তি—“পলাশীর সেই লড়াই যদি-/কেশনগরে ঘটতো/ কেশনগরের মশার ঠেলায়/ক্লাইভ সেদিন হটতো।” কে জানে মশার লাগামহীন উৎপাতের প্রতিক্রিয়ায় কলি কালের ক্লাইভ গোত্রের লোকরা কুপকাত হয় কি না!
শুধু কবিতার বিনোদন নয়, মশাদের কাছে শেখার আছে বাস্তবেরও অনেক কিছু। সরাসরি সুযোগ নেওয়ার কৌশলে মশারা বেশ চৌকস। অন্যদিকে জোগায় গবেষণার প্রেরণা। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, অন্ধকারে মানবকুলের দেখার প্র্যাকটিস। মশারা অন্ধকারে ভালো দেখে। মানুষও এই দক্ষতা অর্জন করতে পারে। নিদেনপক্ষে গবেষণা হতে পারে। তাতে রাতে লোডশেডিং হলে মোমবাতি খুঁজতে হবে না। এদিকে সবাই না মানলেও নিশ্চয়ই কেউ কেউ মানবেন, নানা বৈশিষ্ট্যে মশারা পাখির সমকক্ষ। কবিতা থেকে সাদামাটা ব্যবহারিক জীবন, নান্দনিক সৃষ্টির সক্ষমতা, গবেষণার উপকরণ, কুটির শিল্প থেকে করপোরেট বাণিজ্য, সরকারি টাকায় নিজের পকেট ভারী—কোথায় নেই মশা! শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাখিদের চেয়ে মশারা অগ্রগামী। বিশেষ করে নান্দনিকতা ও বাণিজ্যে। বাবুই পাখির যে বাসা তৈরি করে তার নান্দনিকতার রহস্য এখনো ভেদ করা যায়নি। এ বাসা সুউচ্চ তালগাছে ঝুলতে থাকে, দুলতে থাকে। এ জন্য আমাদের চোখে বেশি পড়ে। কিন্তু যা ঝোলে না, দোলে না; তা হচ্ছে মশার কামড়ের নান্দনিকতা। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, মশককুল যেখানে কামড় দেয় সেখানে লালচে সুন্দর বিন্দু তৈরি হয়। স্বীকার করতেই হবে, বাবুই পাখির বাসা যেমন মানুষ সৃষ্টি করতে পারবে না, তেমনই মানুষ তৈরি করতে পারবে না মানব শরীরে মশার মতো লালচে কোনো শিল্পকর্ম।
আর শুধু শিল্পকর্ম শেখা নয়, সুযোগ কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তাও তো শেখার আছে মশার কাছে। ধরা যাক, আপনি পেল্লায় এক মশারির নিচে নিশ্চিতে চিতপাত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। গভীর ঘুম। তা হোক রাতে অথবা দিনে। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর দেখলেন শরীরের নানান জায়গায় মশারা শিল্পকর্ম করে রেখেছে। আর চোখ কপালে তুলে দেখলেন, স্লিম ফিগারের মশাগুলো আপনার রক্ত খেয়ে রক্তিম আভার এক-একটা ঢোল হয়ে আছে। কী ব্যাপার! কোথা থেকে মশারা ঢুকল? অনেক অনুসন্ধান করে দেখা গেল, মশারির কোণে ছোট একটি ছিদ্র আছে। যা অনেক চেষ্টার দেখা গেছে। ঈদের চাঁদের মতো, যা অনেক চেষ্টায় দেখা যায়। অবশ্য চাঁদ দেখার সেই দিন এখন আর নেই। এর অনেক কারণ আছে। প্রধান হচ্ছে, ‘চাঁদ দেখা গেছে বলে’ ঘোষণা দেওয়ার জন্য সরকারের পাকা ব্যবস্থা। এ জন্য বাহারি সংস্থার নাম চাঁদ দেখা কমিটি। আবার মশাকেন্দ্রিক অনেক কমিটি আছে।
ধরা যাক, মশারির কোথাও কোনো ছিদ্র নেই। তবুও দেখা গেল আপনার হাত-পা অথবা শরীরের কোনো এক বা একাধিক অংশে মশারা শিল্পকর্ম করে দিয়েছে। কী ব্যাপার, কেমনে হলো? তবে এটি গায়েবি কিছু নয়। মোটেই নয় চাঁদে কারও ছবি দেখার মতো আজগুবি বিষয়। এ হচ্ছে আপনার অসাবধানতায় মশাদের সুযোগ নেওয়ার দক্ষতার প্রমাণ। ঘুমের মধ্যে মশারির সঙ্গে আপনার শরীর লেপ্টে থাকার সুযোগ নিয়ে মশারা কম্ম সেরে দিয়েছে। মানতেই হবে, সামান্য সুযোগও হাতছাড়া না করে কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, তা মশাদের কাছে শেখার আছে। আর একটি বাস্তবতাও কিন্তু অনুধাবন করার আছে মশাদের দেখে। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে, অন্যের রক্ত খেয়ে ঢোল হওয়া মশারা সহজেই মারা পড়ে। এ হচ্ছে নানান অসিলায় মানুষের রক্ত চোষার পরিণতি প্রসঙ্গে সচেতন করার ক্ষেত্রে মশাদের অবদান। এমনকি মুক্তিযুদ্ধেও মশাদের ভূমিকা আছে বলে বিবেচনা করা যায়। অনুমান করা চলে, বনেবাদাড়ে-দিনে-রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মশারাও কিন্তু কম শায়েস্তা করেনি! মশাদের অবদান এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। আলু-পটোল-আণ্ডা থেকে শুরু করে ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধকেন্দ্রিক ব্যবসার নামে যত রক্ত চোষা হয়েছে, তা সম্ভবত এখন আর সামলানো যাবে না। এ ব্যাপারে চ্যানেল আইয়ের ২৪ আগস্টের টকশোতে ড. হাসান মনসুর বলেছেন, স্যাংশনের নজর এবার ব্যবসায়ীদের দিকে। কাজেই কখন কার ঘাড়ে স্যাংশনের খড়গ নামে তা আগেভাগে টের পাওয়া কঠিন। যেমন টের পাওয়া কঠিন, কংক্রিটের জঙ্গলে কখন সন্ধ্যা নামে। ‘ইটের ওপর ইট, তাহার মধ্যে বাস করে মানুষ নামের কীট’। কাজেই কখন সন্ধ্যা আর কখন ভোর তা বোঝার ওপর থাকে না। এ ক্ষেত্রে সীমিত পর্যায়ে চড়ই পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ জানান দেয়, ভোর হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার আগমনের জানান দেবে কে? যখন পাখিরা ঘরে ফেরে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে সরকার। মশার বিরুদ্ধে কামান দাগার বেফজুল আয়োজনে নগরবাসীর মনে পড়ে, এবার সন্ধ্যা সমাগত। যখন ঘরে থাকা মানবকুল মশার রাজত্বে অতিষ্ঠ।
শুধু ঘরে নয়, অ্যারোপ্লেন উড্ডয়ন প্র্যাকটিস করতে গিয়েও রাইট ভ্রাতৃদ্বয় যে মশার আক্রমণ সহ্য করেছিলেন, সে ঘটনা খুবই চমকপ্রদ। রাইট ভাইয়েরা মশার আক্রমণের এমন রসাত্মক বর্ণনা দিয়েছেন, যা অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার চেয়ে কম কৌতুকপ্রদ নয়। অনেকেই জানেন, বড় ভাই উইলবার রাইট এবং ছোট ভাই অরভিল রাইট দুজনই সুরসিক ছিলেন। এমনও হতে পারে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতায় আপ্লুত অথবা রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের রসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মশা নিয়ে আমাদের মন্ত্রী-আমলা-কামলারাও নানান ধরনের রসিকতা করেই যাচ্ছেন। তবে চরম রসিকতা সম্ভবত এখনো বাকি আছে। আর তা হচ্ছে, মশাদের লাইগেশন করার উদ্যোগ নেওয়া। যা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে আমাদের দেশে বহু আগে শুরু হয়েছে, এখনো কমবেশি চলছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ‘মহান’ উদ্দেশ্যে আরও যা যা করা হয়েছে, তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। আর মানুষের ইনবিল্ড প্রবণতার অনৈতিক ইচ্ছাপূরণের উপকরণে পরিণত হয়েছে একটি পণ্য। যা কি না দৃষ্টিনন্দন প্যাকেটে ওষুধের দোকানে বিক্রি হয় সবার দৃষ্টিসীমায় রেখে। কিন্তু ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার সময় এক ধরনের মেকি গোপনীয়তার আবহ তৈরি করা হয়। বলাবাহুল্য, এর ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের অনৈতিকতার প্রবণতা এবং নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
মন্তব্য করুন