শিক্ষাজীবনে পরীক্ষা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্যায়ন করে। পরীক্ষা-পরবর্তী সময় শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটি ধাপ কিন্তু এ সময়ে যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, সেটি অনেক সময় পরীক্ষার চাপের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ফল নিয়ে উৎকণ্ঠা, পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা—এসব কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় গভীর মানসিক অস্থিরতা, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ প্রসঙ্গে মার্কিন মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেক বলেন, হতাশার পেছনে মানুষের নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা এবং পারিপার্শ্বিকতার ভুল ব্যাখ্যা—এ তিনটি প্রধান কারণ কাজ করে। পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ তিন মানসিক প্রবণতা হঠাৎই বৃদ্ধি পায়, যা তাদের হতাশ ও সংকুচিত করে তোলে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সাধারণত শিক্ষার্থীদের একটি স্বস্তির সময় কাটানোর কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ শিক্ষার্থী এ সময়ে মানসিক চাপ, হতাশা ও উদ্বেগে ভোগে। বিশেষ করে যারা পরীক্ষা খুব ভালো দেয়নি বা নিজের প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল হবে না বলে মনে করে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও নিজেকে দোষারোপের প্রবণতা দেখা যায়। কখনো কখনো এই মানসিক চাপ থেকে জন্ম নিতে পারে বিষণ্নতা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরীক্ষা-পরবর্তী মানসিক চাপের পেছনে কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক ও পারিবারিক কারণ বিদ্যমান। আমাদের সমাজে ভালো ফলের জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর একটা আলাদা চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কে কতটা জিপিএ পেল, কার ফল কত ভালো, কে কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেল—এসব তুলনা শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানে আঘাত করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবারের অব্যক্ত প্রত্যাশা। এসব বিষয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে হীনম্মন্যতার জন্ম দিতে পারে। এটি সামাজিক তুলনা তত্ত্ব অনুযায়ী স্বাভাবিক; যেখানে মানুষ নিজের সাফল্য অন্যের সঙ্গে তুলনা করে আত্মমূল্যায়ন করে। তবে বারবার নেতিবাচক তুলনা মনোবলে আঘাত হানে।
আবার ডিজিটাল মাধ্যমও পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্যদের ফল নিয়ে আলোচনা, গুজব ও নেতিবাচক তথ্য শিক্ষার্থীদের মনে ভীতি ও হীনম্মন্যতা তৈরি করে। এ সংকট থেকে উত্তরণে প্রথমেই প্রয়োজন সচেতনতা ও সহানুভূতিশীল মনোভাব। পরিবারকে বুঝতে হবে, একজন শিক্ষার্থীর মূল্য শুধু তার পরীক্ষার ফলে নয়, বরং তার চরিত্র, চেষ্টা, নৈতিকতা ও সম্ভাবনার মধ্যে নিহিত। শিশুর সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সে নিজের ব্যর্থতা বা দুর্বলতা নিয়েও খোলামেলা কথা বলতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি। শিক্ষার্থীদের শেখানো যেতে পারে কীভাবে চাপ মোকাবিলা করতে হয়। এ ছাড়া ফল-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য করণীয় ঠিক করে দেওয়া, যেমন স্কিল ডেভেলপমেন্ট, বই পড়া, সামাজিক কাজ বা হালকা সৃজনশীল চর্চা, তাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে।
হ্যান্স সেলিয়ে নামে একজন মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘চাপ নিজে খারাপ নয়; আমরা কীভাবে তা মোকাবিলা করি সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।’ তাই স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং সেবা, হালকা সৃজনশীল কার্যক্রম ও সচেতনতা কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
তা ছাড়া তিনি তার স্ট্রেস থিওরি (Hans Selye’s Stress Theory)-এর মাধ্যমে দেখিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ (chronic stress) শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরীক্ষার পরের দুশ্চিন্তা, ফল নিয়ে ঘুমহীনতা, খাওয়াদাওয়া অনিয়ম—সবই এ স্ট্রেসের উপসর্গ। এ অবস্থায় শরীরে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা উদ্বেগ ও বিষণ্নতা তৈরি করে।
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষ আলাদা, তাদের শেখার ধরন ও উন্নতির গতি ভিন্ন। পরীক্ষার ফল জীবনের একটি অংশমাত্র, সম্পূর্ণ জীবন নয়। একজন শিক্ষার্থী যদি ব্যর্থতার পরেও উঠে দাঁড়াতে পারে, তাহলে সে জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। সেই শক্তি ও মনোবল গঠনে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আরও মানবিক, সহানুভূতিশীল ও সহায়ক হতে হবে। এ সময়টিকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে তাদের ভবিষ্যৎ পথচলায় আত্মবিশ্বাসী হতে পারে।
মো. রেজওয়ান আহমেদ রাজু, শিক্ষার্থী
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
মন্তব্য করুন