বজ্রপাতে জীবনঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রাকৃতিক কারণেই বজ্রমেঘের সৃষ্টি এবং বজ্রমেঘ থেকেই হয় বজ্রপাত। ‘কিউমুলোনিম্বাস’ মেঘ থেকে সাধারণত বজ্রপাতের সৃষ্টি। বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বজ্রমেঘের পরিমাণও বেড়েছে কয়েক বছর ধরে। শীতের পর দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে শুকনো গরম বাতাস আসতে শুরু করে। অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস। এ দুই ধরনের বাতাসের সংমিশ্রণে একরকম অস্থিতিশীল বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি তৈরি। মেঘ চলাচলের সময় বাতাস এক মেঘের সঙ্গে অন্য মেঘের ঘর্ষণের সৃষ্টি করে, যার ফলে বজ্রের সৃষ্টি হয়। বজ্র যখন মাটি অবধি চলে আসে তখনই তাকে বজ্রপাত বলে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে বজ্রমেঘ বৃদ্ধির সময়টা এপ্রিল ও মে মাস। গবেষণা বলছে, ভৌগোলিক ও আবহাওয়াজনিত কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। তবে মৌসুমগত আবহাওয়ার পরিবর্তনই বজ্রপাতের মূল কারণ। আবহাওয়াবিদদের মতে, সত্যিকারে বজ্রপাত হয় অনেক বেশি, তবে সব বজ্র মাটি পর্যন্ত স্পর্শ করে না বলে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। দেশে গাছপালা কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১ থেকে এক দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়ে চলেছে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও। আবহাওয়ার উত্তাপ বাড়াকে বজ্রপাতের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়। আবার সেলফোনের অসংখ্য টাওয়ার নির্মাণও বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকে। আবহাওয়াবিদের মতে, ঊর্ধ্বাকাশে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকার সময়ে উত্তর থেকে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের কারণে একদিক থেকে গরম ও আর্দ্র বাতাস আর অন্যদিক থেকে শীতল বাতাস প্রবাহে বজ্রপাত হয়।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১১ মে দেশের চার জেলায় বজ্রপাতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ২৮ এপ্রিল ১১ জেলায় এক দিনে বজ্রপাতে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর দেশে গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই এপ্রিল থেকে জুন মাসে আর বিশ্বে বজ্রপাতে যত মৃত্যু হয় তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। এককালে বর্ষা এলে আকাশ কখনো ঘনকালো মেঘে ছেয়ে যেত। চমকাত বিদ্যুৎ, শোনা যেত বজ্রপাতের বিকট শব্দ। বেশিরভাগ বজ্র তখন আকাশেই মিলিয়ে যেত। কদাচিৎ দুয়েকটা মাটিতে এসে পড়তেই দেখা যেত উঁচু তাল কিংবা সুপারি গাছের মাথায় এসে ঠেকে গেছে। কিন্তু আজকাল বজ্র যেন যমদূতের রূপ ধারণ করে সব মাটিতে এসে ঠেকছে, মেরে ফেলছে মানুষ। আবহাওয়াবিদদের মতে, বর্তমান সময়ে বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। এ ছাড়া নদী ও জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া, গাছপালা ধ্বংস হওয়ার কারণে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত ঘটায়। যারা ঘরের বাইরে কাজ করেন, যেমন কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষই বেশি বজ্রপাতের শিকার হন।
গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ২৬৫ জনের বেশি মৃত্যু হয় যাদের ৭০ শতাংশ মাঠে কর্মরত কৃষক। দেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই এপ্রিল থেকে জুন মাসে হয়ে থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩ হাজার ৭০০ জন মানুষ প্রাণ হারায়। ২০২১ সালে সারা দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৮১ জন মানুষ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতের ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। ওই বছরের মে মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একই দিনে ৫৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। আর ৬ জুন এক দিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ হারিয়েছে ২৫ জন। এরপরই ২০১৬ সালের ১৭ মে বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বজ্রপাত সাধারণত চার রকমের হয়ে থাকে। প্রথমত, বজ্রপাত সরাসরি আকাশ থেকে মাটিতে চলে আসে। এ ধরনের বজ্রপাতই বেশি প্রাণহানি ঘটায়। অন্য তিনটি হলো—আকাশ থেকে আকাশে, এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে এবং অন্যটি মেঘের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। উঁচু স্থানে বজ্রপাত বেশি হয়। আগে গ্রামগঞ্জে বট, তাল ও নারিকেল গাছের মতো উঁচু গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল। তালগাছের মতো উঁচু গাছ বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে কাছে টেনে নিয়ে ঠেকিয়ে দিত। ফলে বজ্র মাটির কাছে খুব একটা পৌঁছাত না। তাই বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুও কম ঘটত। বজ্রপাত ঠেকাতে খোলা মাঠের তালগাছই বেশি কার্যকর বলে মনে করেন অভিজ্ঞজন। গ্রামগঞ্জে রাস্তার দুপাশে তালগাছের যে দীর্ঘ সারি এখন আর দেখা যাচ্ছে না। উঁচু গাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বজ্র সরাসরি মাটিতে লোকালয়ে এসে পড়ে এবং মানুষের মৃত্যু ঘটায়। বজ্রপাতে সাধারণত দুটি উপায়ে মানুষের মৃত্যু হয়। একটি কারণ প্রত্যক্ষ বা সরাসরি আঘাত, যা মানুষের শরীরের ওপর সরাসরি পড়ে। এ ধরনের ঘটনা কম ঘটে এবং প্রত্যক্ষ কারণে মানুষের মৃত্যুও কম। পরোক্ষ বজ্রাঘাতেই অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ ক্ষেত্রে যেখানে বজ্রপাত আঘাত হানে সেখানকার পুরো জায়গাটি বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। ভূমির এ ধরনের বিদ্যুতায়নে বেশিরভাগ মানুষ মারা যায়।
বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর ২০১৭ সালে বজ্রপাতে প্রাণহানি হ্রাসে সরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী ৬০ লাখ তালগাছ লাগানো হয়। উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে গাছগুলো বেড়ে উঠতে পারেনি। এ ছাড়া বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র লাইটনিং ডিটেক্টর এবং লাইটনিং অ্যারেস্টার সেন্সর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের আটটি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয় বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ার এ অত্যাধুনিক যন্ত্র। এ যন্ত্রের সেন্সরগুলোতে ধারণ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে বিদ্যুৎ চমকানো এবং বজ্রপাতের মাত্রা জানা সম্ভব হতে পারত বলে ধারণা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতের মেঘের প্রকাশ বেশ জটিল। মাত্র আধা বা এক ঘণ্টা আগে এর সম্পর্কে বলা যায়। বজ্রঝড় সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। এ সময়ে বাড়ির বাইরে বের না হওয়া শ্রেয়। ঘরে থেকে দরজা, জানালা বন্ধ রেখে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে নিতে হবে। বজ্রপাতের সময় ঘরের বাইরে অবস্থান করলে খোলা মাঠে বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। একান্তই যদি থাকা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, তবে পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে কানে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব কোনো ভবন বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ। বজ্রপাতের সম্ভাবনা দেখা দিলে উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা তার, সেলফোন টাওয়ার থেকে দূরে চলে যেতে হবে। এমনকি আকাশে ঘন মেঘে বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখলে নদী, পুকুর বা ডোবা এবং যে কোনো জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। এসব স্থান বজ্রকে বেশি আকর্ষণ করে। বজ্রপাতের সময় গাড়ি বা বাসের ভেতর থাকলে কোনো ধাতব অংশকে শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা যাবে না। বজ্রপাতের সময় লোহা বা অন্য ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহারও নিরাপদ নয়। একইভাবে বজ্রপাতের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় সেলফোন ও কম্পিউটার ব্যবহার এবং টেলিভিশন দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে প্রতিটি ভবনে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড রাখা বাধ্যতামূলক করা দরকার। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে হাওর অঞ্চলে টাওয়ার নির্মাণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার নামিয়ে আনতে দেশের সর্বত্র বেশি করে উঁচু গাছ যেমন তাল, নারিকেল, সুপারি, খেজুরগাছ লাগাতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে বসাতে হবে লাইটনিং টাওয়ার বা উঁচু ধাতব পোস্ট। খোলা স্থানে উঁচু টাওয়ারে আরথিং করে নিলে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। বজ্রপাত সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে পারলে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
( প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব )
মন্তব্য করুন