সুমিষ্ট সুগন্ধ আর রঙের আভিজাত্যে অনন্য বিচিত্রা ফুলের ইংরেজি নাম টুডে-ইয়াসটারডে-টুমোরো। প্রকৃতির নির্দিষ্ট সময়ে রং পরিবর্তন করে, বিচিত্র ফুল বিচিত্রা। অন্যদিকে প্রকৃতির অংশ বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র তার চিন্তাভাবনা। যেমন—বাংলাদেশে মানুষের বিচিত্র চিন্তাভাবনায় এখন হ-য-ব-র-ল বর্তমান সমাজব্যবস্থা, যা নিয়ে বুধসমাজে, ব্যক্তিগত মতাদর্শ দ্বারা কমবেশি নিয়ন্ত্রিত, জ্ঞানী-গুণীদের বিভিন্ন মিডিয়ায় চলছে আলোচনা। পাশাপাশি বিশ্বের ‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মঞ্চে’, সিস্টেম চিন্তাবিদদের বিতর্ক চলছে বাংলাদেশের দুরারোগ্য দুর্নীতি নিয়ে। বর্তমান সমাজব্যবস্থা নিয়ে জনগণের জ্ঞানীয় তথ্য ও আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে অনেক প্রশ্ন। যেমন, বর্তমান সমাজব্যবস্থা কী? কোন তন্ত্রবাদীর দর্শনে চলছে বর্তমান সমাজব্যবস্থা? কেন দ্রুত ওঠানামা করছে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যারোমিটার? এই প্রশ্নগুলো সামনে রেখে আজকের নিবন্ধ।
স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আন্তঃবিভাগীয় বহুমাত্রিক বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের চিন্তাভাবনার জালে হৃদয় ও স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় অঙ্গের বিক্রিয়ার ফলাফল বর্তমান সমাজব্যবস্থা। যার মধ্যে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি আমাদের জীবনের প্রবহমান ধারায় এক অসাধারণ বলয়। এ বলয়ের অভাবে শৃঙ্খলিত জীবনযাপনের সরল পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় না। দীর্ঘদিন শৃঙ্খলিত জীবনযাপনের অনুপস্থিতিতে পৃথিবীর যে কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষ ফিরে যেতে পারে মধ্যযুগে। যখন সমাজ থেকেও নেই; মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত, ক্যানিবালিজম প্রথার প্রচলন ছিল বিধায় দুর্বল গোত্রের ওপর শক্তিশালী গোত্র আক্রমণ বা অত্যাচার করলে, দুর্বল গোত্রকে রক্ষা করার জন্য কোনো আইনসম্মত ব্যবস্থা কাজ করত না। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যযুগীয় ক্যানিবালিজম প্রথা বাংলাদেশে ধারণ করেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে, অনেকটা দুরারোগ্য দুর্নীতির মহামারিতে। তাই দুর্বৃত্ত-ধনিকদের দেখতে পাচ্ছেন গাড়িতে। ওরা ‘ব্ল্যাক ফ্লাই’ মাছির মতো বিষাক্ত। স্বার্থের দ্বন্দ্বে ওরা অন্যকে করে রক্তাক্ত। এমন দ্বন্দ্বের সমাজে দেখা দেয় মানুষের ‘নাটকীয় জীবনের পথচলা’। ষড়যন্ত্র তত্ত্বমতে, এ নাটকীয় জীবনের পথচলা সমাজে অদৃশ্য রাজত্ব করে ‘বিজ্ঞাপন’।
হয়তো তাই, তবলার তারানা বাজানোর মতো দ্রুতগতিতে বিজ্ঞাপনের চাদরে ঢাকতে শুরু করেছে অনিন্দনীয় দেশের দৃষ্টিনন্দন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন, যা অনেকটা দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক বংগ জন হুর পরিচালনায় সত্য জীবনের ঘটনা অবলম্বনে অস্কারজয়ী ‘পরজীবী’ (প্যারাসাইট) মুভির মতো। পরজীবী মুভিতে অনেক অপ্রকাশ্য বার্তার মধ্যে একটি হলো—রৈখিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল পুঁজিবাদী সমাজ মধ্যযুগের ক্যানিবালিজম (রূপক অর্থে) প্রথার দিকে ধাবমান। এ ধরনের পুঁজিবাদী সমাজের কথা ভেবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে খ্যাতিমান চিন্তাবিদরা বলেছিলেন, ‘সমকালীন সমাজ কাঠামো ব্যক্তির বিকাশের পথে অন্তরায়, যা মানুষকে মানুষের মুখোমুখি করে দেয়, তাকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে বাধ্য করে।’
নৃতাত্ত্বিক যুগের বিজ্ঞানীদের মতে, সবুজবান্ধব সমাজ গঠন তথা সমকালীন সমাজ কাঠামো নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল, আছে কিংবা থাকবে। তাই, গত আশির দশকে বাংলাদেশি শিল্পী তপন চৌধুরীর গাওয়া ‘যেতে যেতে কেন পড়ে বাধা’ গানটি সমাজ জীবনে বেশি প্রাসঙ্গিক বললে ভুল হবে না। কারণ এ গানের কথার মতো—‘আমাদের দিন যায় রাত আসে, মাস যায় বছর আসে আর সুন্দর দেশের স্বপ্ন আমাদের চোখের মণিতে ভাসে’। হয়তো তাই, সুন্দর দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য গত বছর ৮ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনেক বক্তব্যে বলেছেন, ওপরে বর্ণিত সমাজের কথা, সাধারণ মানুষের কথা, বৈষম্যহীন দেশের কথা, চার কোটি গরিব জনপদের কথা, গণতন্ত্রের কথা এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের কথা। যেমন—গত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন ২০২৫-এর অনুষ্ঠানে উৎসাহব্যঞ্জক ভাষণে বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘বিশ্বকে বদলে দেওয়ার মতো অভিনব সব ধারণা রয়েছে বাংলাদেশের।’
ড. ইউনূসের বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনের ভাষণ নিবিষ্ট মনে শ্রবণকারী দেশপ্রেমিক জনগণ জানতে চায়, উৎসাহব্যঞ্জক ভাষণের লক্ষ্য কোনটি? (ক) চীনের মতো অর্থনৈতিক হাব তৈরি করা, (খ) মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল ২০৩০-এর মাধ্যমে দেশের উন্নতি করা এবং (গ) বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অর্থনীতির কোন মডেল নিয়ে দেশে ব্যবসা করতে আসবেন: রৈখিক (linear) নাকি বৃত্ত (circular)?
জনগণ আরও জানতে চায়, দেশে টেকসই অর্থনীতির নীতিনির্ধারক কারা? এ প্রশ্নের ব্যবচ্ছেদে দেখা যায় (i) রাজনৈতিক বলয়ে অর্থনীতির স্বরূপ অনুধাবন করা প্রয়োজন; (ii) গত বছরে পতিত সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বানানো হয়েছিল সাক্ষীগোপাল; এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটুক তা জনগণ ও বুধসমাজের কেউই চান না এবং (iii) জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক সুদৃঢ় ও স্বচ্ছ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। হয়তো এ সম্পর্কের অভাবে বাংলাদেশের আশপাশে বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটলেও ঘটতে পারে। এজন্যই কি ড. ইউনূস বলেছেন, ‘এমন বিশ্বে আমরা বাস করি, প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি আমাদের ঘিরে থাকে।’ কাজেই এ পরিস্থিতির মধ্যে প্রস্তুতি না নেওয়াটা ‘আত্মঘাতী’। এ বিবৃতির অর্থ দাঁড়ায়, দেশ এখন গভীর ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি। তাই দেশের জনগণ আতঙ্কিত।
ওপরে বর্ণিত দেশের বিবৃতি শুনে আতঙ্কিত জনগণের উদ্দেশে দেশের বিচক্ষণ রাজনৈতিক ছত্রপতিদের মধ্যে বিপুল জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না।’
অন্যদিকে, সমাজচিন্তকদের মতে, ড. ইউনূসের বক্তব্যে সুস্পষ্ট বলিষ্ঠ (উগ্র) জাতীয়তাবাদের লক্ষণ প্রতীয়মান। উগ্র জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশে নতুন যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। যেমন—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) জার্মান সেনাবাহিনীর বর্বর বৃক্ষটির মূলে পানি দিয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ। এ আলোচ্য বিষয়ের সূত্র ধরে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ উগ্র জাতীয়তাবাদ নিয়ে যতটা চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত বর্তমান সমাজব্যবস্থা তথা দেশের উন্নতি নিয়ে। কারণ ষড়যন্ত্র তত্ত্বমতে, বর্তমানে দেশে সংস্কারের নামে, রাজনীতির নামে, ভূরাজনীতির নামে, অর্থনীতির নামে, বৈদেশিক সাহায্যের নামে দেশের ভেতরে এক ধরনের ভীতিকর, এক ধরনের অস্থিতিশীলতা, এক ধরনের অরাজকতা, এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং এক ধরনের নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হতে চলেছে। অন্তনীল মনের প্রশ্ন, দেশে এ ধরনের অবস্থা তৈরি করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করছে কারা? প্রিয় পাঠক, প্রশ্নের উত্তরটা পেতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিমেটর ও কার্টুনিস্ট Walter Crawford Kelly Jr. (১৯১৩-১৯৭৩)-এর তৈরি পোগো কার্টুনের বিখ্যাত একটি লাইনের মধ্যে। লাইনটি হলো—‘আমরা শত্রুর সঙ্গে দেখা করেছি এবং সে আমাদের।’
ওপরের অনুচ্ছেদে অদৃশ্য শক্তির পোগো কার্টুন পরোক্ষভাবে বলে দিয়েছে, বিজ্ঞাপনের রাজত্ব পরিচালনা গোষ্ঠী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুখটাকে ঢেকে, মুখোশটাকে জীবিত রাখার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষের সম্ভাবনা নিয়ে চলছে রাজনীতি ও কূটনীতি, যা বন্ধ করা অতীব জরুরি। নতুবা মেক্সিকোর টিলটেপেক গ্রামের (Tiltepec Village, where everyone turns blind) মতো আমাদের সমাজ হবে অন্ধ। তাই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ক্ষয়িষ্ণু সময়ে পচে না গিয়ে টিকে থাকা রাজনৈতিক ছত্রপতিরা বর্তমান সমাজ বা দেশ নিয়ে আলোচনার কথা বলতে চেয়েছেন এইভাবে, অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে, বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় সামুদ্রিক লাল অ্যালগি শৈবালের দ্বীপ দারুচিনিতে বসে আলোচনার বিষয় হতে পারে ‘পৃথিবীতে সুখ ও শান্তির মডেল বাংলাদেশ’। আলোচনার এখনই আদর্শ সময়। আমন্ত্রিত মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি তাদের অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে এখন তাদের আকাঙ্ক্ষাকে একবিন্দুতে মেলাতে পারা যায়, তাহলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দেশের রাজনৈতিক ছত্রপতিদের আলোচনার পরিকল্পনা চূড়ান্তভাবে সফল হবে। ফলে দেশে বিজ্ঞাপনের রাজত্বের পরিবর্তে রাজ্য পরিচালনা করবে সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার।
হয়তো তখন থেকে (১) সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি আমাদের জীবনের প্রবহমান ধারায় এক অসাধারণ বলয়ের চাকা ঘুরবে; (২) দুর্বৃত্ত-ধনিকরা পলায়নের দিন গুনবে; (৩) সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যারোমিটার দ্রুত ওঠানামা করবে না; (৪) শুরু হবে সবুজবান্ধব সমাজ গড়া এবং (৫) বিচিত্রা ফুলের মতো সুমিষ্ট সুগন্ধে মারুত বহিবে বাংলার ঘরে ঘরে।
প্রিয় পাঠক, দেশের ঠিক এমন অবস্থায় আপনার মুখের মিষ্টি হাসি আমাদের তথা বিশ্ববাসীকে বলে দেবে বর্তমান ‘হ-য-ব-র-ল সমাজব্যবস্থার দিন শেষ, সুখ ও শান্তির বাংলাদেশ’।
লেখক: সমাজবিজ্ঞানী, টেকসই রিনিউবল এনার্জি ও সার্কুলার অর্থনীতি এক্সপার্ট
মন্তব্য করুন