পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে স্বীকৃত মানুষ। যদিও নিজেরাই নিজেদের এ শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তা প্রতিষ্ঠাও পেয়েছে। দুনিয়াজুড়ে সম্পদের খোঁজে তারা নানা লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। সভ্যতার চরম উৎকর্ষের দাবিদার মানুষ এখন মহাশূন্য জয়ের চেষ্টা করছে। পৃথিবীর মতো অন্য গ্রহকেও বাসযোগ্য করার গবেষণা চলছে। যদিও অতি লোভে পৃথিবীকেই বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে দিনকে দিন এ মানুষই। লোভ-লালসা প্রাগৈতিহাসিক কালের চেয়েও বেড়েছে। বর্বরতা কমেনি। আধুনিক উপকরণে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। খোলা প্রান্তরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দিয়ে হাইকমোড ব্যবহার করছে। কিন্তু কাজ আগেরটাই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হলেও মানুষ এখনো সত্যিকারের মানুষ হয়নি। অতিপ্রাকৃতকালে প্রকৃতি ও পশুর সঙ্গে যুদ্ধ করে সভ্যতার দিকে এগিয়েছে। কিন্তু মনস্তত্ত্ব থেকে যায়নি পাশবিকতা। মন থেকে পশুত্ব দূর করতে শিক্ষা, মানবতা, ধর্মচর্চা করে মানুষ। অথচ এসব কিছুর নাম করেই অধর্ম করে তারা। বাণিজ্য পসারে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ধর্মের নামে। ক্ষমতা বাড়াতে অভিযানের নামে মানুষ হত্যা ও প্রকৃতি ধ্বংস করে। আধুনিক এ যুগে আত্মহননের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তথাকথিত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। বছরের পর বছর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ বাধিয়ে রাখে তারা। এমনকি তাদের রচিত যুদ্ধনীতিও মানে না তারা। ফলে দৈত্য-দানোর অন্ধকার যুগের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ খেটেখাওয়া মানুষ। স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন আজ বিধ্বস্ত গাজার রক্তাক্ত প্রান্তরে।
প্রায় ২০ মাসে একতরফা যুদ্ধে গাজায় ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এর অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। আহত ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখো ফিলিস্তিনি। বেসামরিক আবাসিক এলাকা, আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি ইসরায়েলি বাহিনীর হাত থেকে। রোজা, ঈদ কোনোদিনই হামলা বন্ধ হয়নি। যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়েও কথা রাখেনি ইসরায়েল। এমনকি ত্রাণ নিতে এসে খুন হচ্ছে ক্ষুধার্ত গাজাবাসী। জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতায় বাধা দিচ্ছে দখলদার বাহিনী। ইউরোপ-আমেরিকার মানবাধিকারকর্মীরাও রেহাই পাচ্ছে না হামলা থেকে। সংবাদকর্মীরা শিকার হচ্ছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার নৃশংস হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসস্তূপে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, এখন গাজাকে বলা হচ্ছে ‘মর্ত্যের নরক’। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে এক বিস্ময়কর পরিকল্পনার কথা জানান ইসরায়েলের একনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসিত করে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তারা উপত্যকাটির উন্নয়ন করে মালিক হবে। গাজা হবে সারা বিশ্বের মানুষের বাড়ি।’ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্পের পরিকল্পনাটি ‘খুবই ভালো’ বলে অভিহিত করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে ফিলিস্তিনি, আরবরা এ পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অনেক পশ্চিমা দেশও এ পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করে। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ট্রাম্পের পরিকল্পনাটি জাতিগত নিধনের সঙ্গে তুলনা করে।
‘ইসরায়েলি সেনারা অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় শখের বশে ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করছে। দেশটি দ্রুত একটি অযোগ্য ও একঘরে রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন সেখানকার বিরোধী দলের শীর্ষনেতা ইয়ার গোলান। গত ২০ মে এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ‘যদি আমরা সুস্থ রাষ্ট্র হিসেবে আচরণে ফিরতে না পারি, তবে ইসরায়েল দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। একটি সুস্থ রাষ্ট্র কখনো সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না, শখের বশে শিশুদের হত্যা করে না এবং জনগণকে জোরপূর্বক বিতাড়নের লক্ষ্য গ্রহণ করে না।’ কিন্তু তার এ ভালো কথা যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর ভালো লাগেনি। সম্প্রতি ইরানে হামলা করে যুদ্ধকে আরও বিস্তৃত করেছে ইসরায়েল। এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় কম্পমান। তবে কোনো সামর্থ্যবান ইসলামী রাষ্ট্র ইরান বা গাজার পাশে দাঁড়াচ্ছে না। এমনকি সারা বিশ্বের প্রতিবাদী মুসলিমদের আবেগ পিএলও নেতা মাহমুদ আব্বাসও নীরব। অথচ সাবেক পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের দিকে পুরো দুনিয়ার নজর কাড়তে পেরেছিলেন। যদিও এ বিপ্লবীর শেষ জীবন নিয়ে হতাশা আছে মুসলিম উম্মাহর। ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের এজেন্ট এক রোমান ক্যাথলিক নারীকে পড়ন্ত বেলায় বিয়ে করেন আরাফাত। তাকে পোলোনিয়াম নামের একটা বিরল এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের লাওসেনের ‘ইনস্টিটিউট ডি রেডিওফিজিকস’ এ কথা জানিয়েছে। এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফ্রাঁসোয়া বোচুড জানিয়েছেন, ইয়াসির আরাফাতের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পরীক্ষা করে তাতে জৈবিক তরল পদার্থের উপস্থিতির পাশাপাশি উচ্চমাত্রার পোলোনিয়াম-২১০ পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, প্যারিসের হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে এসব জিনিসপত্র ইয়াসির আরাফাত ব্যবহার করেছেন। আরাফাতের স্ত্রী সুহা আরাফাত এসব জিনিস তাদের দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
ফিলিস্তিনি জাতির প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয় মাহমুদ দারবিশকে। তার কবিতায় দেশপ্রেম ও বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয় জাতি। অথচ দুই বিয়ের পর এক ইহুদি নারীর প্রেমে পড়ে তিনি লিখেছিলেন—‘আমি আমার জাতির সঙ্গে বেইমানি করে, আমার শহর এবং তার পরাধীনতার শিকলগুলোর বেদনা ভুলে গিয়ে হলেও তোমাকে ভালোবাসি।’ এরপর কবি আবিষ্কার করলেন, তার প্রিয়তমা প্রেমিকা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করেন। তিনি লিখলেন, ‘Between Rita and my eyes, There is a rifle’—তখন গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয় তার লেখা ‘রিটা অ্যান্ড দ্য রাইফেল’ কবিতাটি। দারবিশ আবার লেখেন— ‘তোমার কাছে কিছুই ছিল না যেই প্রেমটা, আমার কাছে সেইটা আমার অস্তিত্ব ছিল।’ ততক্ষণে সব শেষ। নির্বাসিত জীবনে শুধু নিজের নয়, দেশের অস্তিত্বও তাকে পুড়িয়েছে। যুগে যুগে মধ্যপ্রাচ্যে জীবনবাজি রাখা বিপ্লবীরা মোসাদের নারী টোপের শিকার হয়েছেন অনেকেই। এমনকি, জনশ্রুতি আছে; আরব দুনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা-বাদশা, বিখ্যাত ব্যবসায়ী, সৃষ্টিশীল মানুষ, উঠতি প্রতিভা সবাই কোনো না কোনোভাবে মোসাদের জালে জড়িয়ে আছেন। ক্ষমতা, নারী আর বিলাসিতার আসক্তি মাদকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যে কারণে সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো ইসলামের চেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুগত। মোসাদের সরবরাহ করা নারী এজেন্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকের বিবি অথবা বান্ধবী। তা ছাড়া সারা বিশ্বের মুসলিমরা নিজেদের এক পরিবার ভাবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমরা নানা কৌম, শিয়া-সুন্নি, স্থানীয় সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিভক্ত। তারা নিজেদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে শুধু ধর্মীয় কারণে ঐক্যবদ্ধ হবে না। যদিও ধর্মীয় লেবাস ও অভ্যাসের ব্যাপারে তারা খুবই উৎসাহী। গত ৭৭ বছরে চারটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়। প্রতিটি যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। ফিলিস্তিনিরা ক্রমেই নিজ ভূমিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এ সময়কালে ইসরায়েলের দখলদারি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে।
ইসরায়েল এবং ইহুদিদের সম্পর্কে বিশ্বের উন্নত ও প্রগতিশীলদের অনেকের ধারণা বেশ উঁচু। তারা বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকলা ও দর্শন উপভোগ করে। ন্যায়নিষ্ঠ পরিমিত জীবনযাপন করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইউরোপ-আমেরিকার সমকক্ষ। যুদ্ধ এবং গোয়েন্দা নীতিতে অপ্রতিরোধ্য। ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা কারও ক্ষতি করে না। মানবকল্যাণে দুনিয়াজুড়ে দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালায়। এসব প্রচারণার উল্টো চিত্র খুব ভয়ংকর। মোসাদকে খুনি বাহিনী মনে করে ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ ও দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদরা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিষ্ঠুর মোসাদের একজন সাবেক উগ্র সদস্য। ক্ষমতায় টিকে থাকতে যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম হত্যা বেছে নিয়েছেন বলে প্রতিবাদ করছেন ভুক্তভোগী ইসরায়েলিরা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অনাচারের সঙ্গে পেরে উঠছে না শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তারা মুসলিম নিধন করছে কীভাবে? তাদের ধর্ম কি মানুষ হত্যা সমর্থন করে? ঐশী গ্রন্থ হিসেবে কোরআনে তাদের তাওরাতের উল্লেখ আছে। কুষ্ঠি বিবেচনায় মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদি একই পরিবারভুক্ত। সবাই হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর।
আসলে ব্যাপারটি শুধু ধর্মীয় ঐতিহ্যের বিষয় নয়। অর্থনীতি ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। সব যুদ্ধের লাভক্ষতির ভাগাভাগি হয় বিশ্বমোড়লদের দরবারে। তাদের নিজ দেশ এবং বিশ্বের নাগরিকদের এক চোখে দেখেন না তারা। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশই যুদ্ধবাজ। একই সঙ্গে তারা আবার মানবতার পক্ষে নানা উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এটি নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে। লোভী ব্যবসায়ী ট্রাম্প, দুর্ধর্ষ কেজিবির সাবেক সদস্য পুতিন, ইঁচড়ে পাকা মাখোঁ, কমেডিয়ান জেলেনস্কি, ভোগবিলাসী সালমান ও উগ্রবাদী মোদিদের হাতে এখন বিশ্বনেতৃত্ব। পক্ষান্তরে জর্জ বার্নার্ড শ, পিকাসো, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মহাত্মা গান্ধী, আইনস্টাইন, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বিশ্বকণ্ঠের অভাব। ‘যথেষ্ট হয়েছে, এবার থামো’—এটা বলার মতো সাহসী, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ লোক নেই। অস্থির প্রতিযোগিতার এ যুগে বিপ্লবী, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিক, বেকার, ভিক্ষুক কেউই চরিত্র ধরে রাখতে পারছে না।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন