দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের মানুষকে রাজনীতির বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিয়েছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আপসহীন দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করার পর থেকে আওয়ামী নিপীড়নমুখী রাষ্ট্রযন্ত্র রাজনীতি থেকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষকে। গুম, খুন আর নির্বিচার আটকের পরও নির্বিকারভাবে রাজপথের লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর তাদের এই হার না মানা লড়াইয়ে তারেক রহমান ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। মিথ্যা মামলা আর প্রাণনাশের শঙ্কায় তাকে দেশ ছাড়তে হলেও সুদূর প্রবাসে থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামে।
শিক্ষার্থী-জনতার সফল অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদ পতন হলেও নির্বাচন নিয়ে শুরু হয় টালবাহানা। এমন সংকট মোকাবিলায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তারেক রহমান। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি সফল হন। সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে সম্মত হয় বর্তমান সরকার। নির্বাচনের এ ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাংলাদেশের গণমুখী রাজনীতির পুনর্জাগরণ ঘটেছে। যেখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তারেক রহমান।
সভ্যতা, ভব্যতা আর ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে ক্ষমতাসীনদের আস্ফালন আর তার বিপরীতে বিরোধীমত দমনপীড়ন, একটা অসুস্থ সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ভয়াবহ এ প্রবণতার কারণে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মন খারাপ করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল রাজনীতি থেকে। এমনি পরিস্থিতিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান যেন সবকিছুর সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে। নতুন করে গণতন্ত্র বিকাশের সম্ভাবনা যেমন উঁকি দিচ্ছে, তেমনি সুপথে তথা নিজ কক্ষপথে ফিরতে শুরু করেছে বাংলাদেশে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া রাজনীতি। আর এজন্যই গত ১৩ জুন অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠকটি বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন আন্তরিক পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি। আর আলোচনা শুরু থেকে শেষ পুরোটা সময় ছিল ভদ্রতা, সভ্যতা আর আন্তরিকতার ছোঁয়া। তার থেকেও বড় কথা জনগণের ভোটে সরকার গঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বহুদিন পর। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগেই হতে যাচ্ছে নির্বাচন। অবশ্যই এ নির্বাচনে দেশের মানুষ সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করতে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠক ও কৌশলগত আলোচনা থেকে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে—যখন অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, ঠিক তখনই অধ্যাপক ইউনূস ঠান্ডা মাথায় কৌশল আঁকছেন, আলোচনার টেবিলে হিসাব কষে এগোচ্ছেন। ঈদের আগেই সরকার এপ্রিল মাসে নির্বাচন আয়োজনের যে বার্তা দিয়েছিল, তা অনেকের চোখে সাধারণ ঘোষণা মনে হলেও, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহল বুঝেছে—এটা ছিল একটি সুপরিকল্পিত দর-কষাকষির চাল। এটা বুঝতে তারেক রহমান দেরি করেননি।
সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত আলোচনায় পরিষ্কার হয়েছে—সরকার এখন বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। জামায়াত এবং নবীন দল এনসিপি যদিও এপ্রিলের নির্বাচনকে ইতিবাচকভাবে দেখিয়েছে, কিন্তু সরকার সেসব গুরুত্ব দিতে নারাজ বলে মনে হয়েছে। আর এ পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার সিংহভাগ কৃতিত্ব তারেক রহমানের।
জামায়াত চেয়েছিল কিছু রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে, কিন্তু সেটি করতে পারেনি। আর এনসিপি এখনো রাজনৈতিকভাবে পরিণত হয়নি—তাদের অবস্থান এখনো পর্যবেক্ষণের পর্যায়ে। সুতরাং সরকার বিএনপিকেই মুখ্য রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। এর মূল কারণ তারেক রহমানের যুগান্তকারী নেতৃত্ব এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অদম্য সাহস। তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত এবং তার দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান সরকার নির্বাচনসংক্রান্ত নমনীয়তা দেখিয়েছে—তবে সেটাও শর্তসাপেক্ষে। এ শর্ত অনেকটাই নির্ভর করছে বিএনপি কতটুকু ছাড় দিতে রাজি তা নিয়ে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহকে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই দেখি। কারণ, ক্ষমতাসীন সরকার হয়তো মিডিয়ার মাধ্যমে, কিংবা প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে তারেক রহমানের বিএনপিকে মোকাবিলা করতে পারে, কিন্তু তারা জানে রাজপথে সক্রিয় বিএনপি বা ব্যালটযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিএনপি হলো এমন একটি শক্তি, যাকে সরাসরি উপেক্ষা করা যায় না। অতীত অভিজ্ঞতা এবং জনমনে বিএনপির প্রভাব সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সতর্ক থাকতে বাধ্য করেছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারও চাইছে বিএনপি যেন মাঠ ছেড়ে আলোচনার টেবিলে আসে, কারণ আলোচনার মাধ্যমে বিএনপিকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করাটা তাদের জন্য তুলনামূলক সহজ।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—সেই আলোচিত বৈঠকে আসলে কী কী আলোচনা হয়েছে? এমন কী আলোচনা হয়েছে, যা সাংবাদিকদের সামনে আসেনি? শুধু ‘সংস্কার’ নাকি এর বাইরেও আছে কিছু অঘোষিত সমঝোতা? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে। তবে একটি ব্যাপার নিশ্চিত—বিএনপি জয় পায়নি, কিন্তু হেরেও যায়নি। বরং তারা একধরনের কৌশলগত অনিশ্চয়তায় আটকে গেছে, যেখান থেকে বের হওয়ার উপায় নির্ভর করছে তাদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং অনলাইন ও রাজপথের ব্যালান্স কীভাবে ধরে রাখতে পারে তার ওপর। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপির সফলতা পুরোপুরি তারেক রহমানের উপযুক্ত নেতৃত্বের ওপরই নির্ভরশীল।
এ বৈঠক আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করেছে—প্রফেসর ইউনূস নিজে ক্ষমতায় যেতে চান না। বরং তিনি একটি কাঠামোগত সংস্কার নিশ্চিত করতে চান, যাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ রাজনীতি আরও সহনশীল ও কাঠামোবদ্ধ হয়। বিএনপির এখনকার সবচেয়ে বড় কৌশলগত দায়িত্ব হবে—প্রফেসর ইউনূসের এ চাওয়া এবং নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য একবিন্দুতে মেলানো। এটা সহজ কাজ নয়—চিন্তা, সময় এবং তারেক রহমানের মতো কৌশলী নেতৃত্ব দরকার।
সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় খেলা এখন মাঠে নয়, টেবিলে। আর সেই খেলায় যারা কৌশলী, বিচক্ষণ ও ধৈর্যশীল—তাদের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি সেই প্রস্তুতিটুকু নিচ্ছে? তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সমঝোতায় দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, তা হচ্ছে—আলোচনার শক্তি ও নেতৃত্বের দায়িত্ববোধ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে জটিল এবং বহুস্তরীয় টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল—বিশেষ করে সেনাবাহিনী, ইউনূসপন্থি গোষ্ঠী, বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির মধ্যকার অবস্থানগত দ্বন্দ্ব—তার একটি পরিমিত, কূটনৈতিক এবং আপাতত শান্তিপূর্ণ সমাধান মিলেছে ঐতিহাসিক এ বৈঠকের মাধ্যমে। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা বহন করে, যা শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্যও স্বস্তির।
ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, কৌশলগত দূরদৃষ্টি এবং সর্বোপরি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সংকট সমাধানের সদিচ্ছার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। এ দুই ব্যক্তিত্বের আলোচনায় বসা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, এটি এমন একটি মুহূর্ত; যা প্রমাণ করে যে ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় অবস্থান যতটাই প্রতিকূল হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে যখন নেতৃত্ব দায়িত্বশীল হয়, তখনই একটি জাতি সংকটের মুখোমুখি হয়েও সম্ভাবনার পথ খুঁজে নিতে পারে।
এ আলোচনা ছিল একটি উচ্চতর রাজনৈতিক বার্তা। বার্তাটি হলো—রাজনীতি মানেই সংঘাত নয়; রাজনীতি আলোচনার, সহমত গঠনের ও সমস্যার সমাধান খোঁজার জায়গা। এ ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা একটি বার্তা দেয়—যখন হুমকি ও রাজপথের উত্তেজনার বদলে আলোচনার টেবিল সক্রিয় হয়, তখন একটি রাষ্ট্র তার প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্রে ফিরে যেতে পারে। এর ভেতরে ভবিষ্যতের জন্য রয়েছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন। আর এর মধ্য দিয়েই রাজনীতি ফিরেছে তার চিরচেনা কক্ষপথে। রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের ভরসা নতুনভাবে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়; ডিরেক্টর (ফিন্যান্স) জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন
মন্তব্য করুন